জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক পড়েছে। আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে পতাকাবাহী গাড়িসহ শোডাউন, মিছিল, মোটর শোভাযাত্রাসহ মনোনয়নপত্র জমা দেন অনেক প্রার্থী। এসব প্রার্থীর অনেককে শোকজ (কারণ দর্শানো) করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেও সংবর্ধনা, সাংবাদিক লাঞ্ছনা ও হুমকিমূলক বক্তব্যের জন্য শোকজ করা হয়েছে কয়েকজনকে। বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সরকারের চার মন্ত্রীসহ ২৪ জনকে এসব অভিযোগে শোকজ করা হয়।
ইসি সূত্র জানায়, দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন থেকেই প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। দলের মনোনয়ন পেয়ে অনেক প্রার্থীই নিজ নিজ সংসদীয় আসনে বিশাল মিটিং, মিছিল, মোটর শোভাযাত্রাসহ নানাভাবে শোডাউন করছেন। অনেক প্রার্থী রাস্তাঘাট বন্ধ করে গণসংবর্ধনা নেন। সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছিল। যদিও নির্বাচন কমিশন থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, এসব এখন ইসির দেখার দায়িত্ব নয়। কমিশনারদের মতে, মনোনয়নপত্র জমাদানের পর থেকেই তা দেখবে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের এমন মনোভাবের পর আচরণবিধি লঙ্ঘনে আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন প্রার্থীরা।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী পুলিশ প্রটোকলে জাতীয় পতাকাবাহী গাড়ি নিয়ে দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। আচরণবিধি ভঙ্গ করে মনোনয়ন জমা দিতে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সামশুল হক চৌধুরী বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আমি শুধু আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রটোকল পাব না, পতাকা পাব না। সুতরাং পতাকা ও প্রটোকল বন্ধ হবে আমার এলাকায় ঢুকলে।’
তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ১৪ (১) ও ১৪ (২) ধারা অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার সঙ্গে তাহার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড যোগ করিতে পারিবেন না। আর সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুবিধাভোগ করিতে পারিবেন না।
সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাদের সমপদমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র।
শত শত দলীয় নেতাকর্মী নিয়ে শোডাউন করে সিলেট-৪ আসনের মনোয়নপত্র জমা দেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এবং সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিলেট আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খান, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফারুক আহমদ, জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামীম আহমদ, গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আসলাম, সাধারণ সম্পাদক ও পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. গোলাম কিবরিয়া হেলাল, জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম লিয়াকত আলী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী আমজদ, সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট জেলা পরিষদ সদস্য আপ্তাব আলী কালাসহ শত শত কর্মী-সমর্থক।
ঢাকা-৬ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রায় ১০০ জনের একটি মিছিল নিয়ে গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেন। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের প্রবেশদ্বার থেকে লাঙ্গলের মিছিল নিয়ে ভেতরে আসেন কাজী ফিরোজ। এ সময় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা তার নামে স্লোগান দিতে দিতে ভেতরে আসেন। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে প্রধান ফটকে এসেও কাজী ফিরোজের সমর্থকরা হাততালি ও বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে ভবনে প্রবেশ করেন। কর্মী-সমর্থকদের এমন ভিড় দেখে প্রধান ফটক থেকে নিরাপত্তারক্ষীরাও পিছু হটতে বাধ্য হন।
শোডাউন করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে সাংবাদিকের ওপর চড়াও হওয়ার অভিযোগ এসেছে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে হাতাহাতিতেও জড়ান বলে অভিযোগ করেন সাংবাদিকরা। অস্ত্রধারীসহ শোডাউন করে মনোনয়নপত্র জমা দেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
মাগুরা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ঘোষণার পর গত বুধবার ঢাকা থেকে মাগুরা যাওয়ার সময় সাকিব আল হাসান কামারখালী থেকে শোডাউন করে গাড়িবহর নিয়ে মাগুরা শহরে প্রবেশ করেন এবং নাগরিক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এতে জনগণের চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়।
এদিকে, আচরণবিধি ভেঙে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারযোগে মিছিল ও শোডাউন করে মনোনয়নপত্র দাখিল করায় চুয়াডাঙ্গা-১ (আলমডাঙ্গা-সদর একাংশ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাকে আগামী রোববার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠন করা চুয়াডাঙ্গা-১ নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির কাছে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. সাজ্জাদুর রহমানের স্বাক্ষর করা চিঠি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনকে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘আপনি কেন নির্বাচনী আচারণ বিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন, সে বিষয়ে আগামী ৩ ডিসেম্বর রোববার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে সশরীরে অথবা উপযুক্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে উপস্থিতি হয়ে লিখিত ব্যাখা প্রদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।’
এ অবস্থায় নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের এ ধরনের নানা অভিযোগে সরকারের ৪ মন্ত্রীসহ ২৪ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে শোকজ (কারণ দর্শানো) করেছে ইসি। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও রয়েছেন। এ বিষয়ে শুক্রবারের মধ্যেই তাদের জবাব দিতে বলেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। শোকজের গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেছে কমিটি।
যাদের শোকজ করা হয়, তারা হলেন—নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, গাজীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও ঢাকা-১৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, নাটোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও নরসিংদী-৫ রায়পুরা আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, গাজীপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী (ক্রিকেটার) সাকিব আল হাসান, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-৬ আসনে দলের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ, ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন খান, লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর-সদর আংশিক) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন ও লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম ফারুক পিংকু, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, পটুয়াখালী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিব্বুর রহমান, রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তুষার কান্তি মণ্ডল, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, নাটোর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম শিমুল ও ময়মনসিংহ-১১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজিম উদ্দীন আহম্মেদ ধনু । এ ছাড়া নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আহসানুল ইসলাম রিমনকেও উসকানিমূলক বক্তব্যের জন্য শোকজ করা হয়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা এর মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ সময়ের আগে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারবেন না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি। সে হিসেবে ১৫ ডিসেম্বরের আগে কেউই নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন না।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যুরো ও জেলা প্রতিনিধি।)