যমুনা নিউজ বিডিঃ ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের মামলায় ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ ৪৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম এ রায় ঘোষণা করেন।
কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন- মো. দিদারুল আলম, হারুন-অর-রশিদ, জেসমিন আক্তার (মিলন), জিয়াউল হক মোল্লা, সাইফুল ইসলাম রুবেল, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন, ডেসটিনির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোফরানুল হক, পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন, ফারাহ দীবা, সাঈদ-উর-রহমান, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, জমশেদ আরা চৌধুরী, ইরফান আহমেদ, শেখ তৈয়বুর রহমান, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, এসএম আহসানুল কবির, জুবায়ের হোসেন, মোসাদ্দেক আলী খান, আবদুল মান্নান, আবুল কালাম আজাদ, আজাদ রহমান, মো. আকবর হোসেন সুমন, মো. সুমন আলী খান, শিরীন আকতার, রফিকুল ইসলাম সরকার, মো. মজিবুর রহমান, ড. এম হায়দারুজ্জামান, মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, কাজী মো. ফজলুল করিম, মোল্লা আল আমীন, মো. শফিউল ইসলাম, ওমর ফারুক, সিকদার কবিরুল ইসলাম, মো. ফিরোজ আলম, সুনীল বরণ কর্মকার ওরফে এসবি কর্মকার, ফরিদ আকতার, এস সহিদুজ্জামান চয়ন, আবদুর রহমান তপন, সাকিবুজ্জামান খান, এসএম আহসানুল কবির (বিপ্লব), এএইচএম আতাউর রহমান রেজা, গোলাম কিবরিয়া মিল্টন, মো. আতিকুর রহমান, খন্দকার বেনজীর আহমেদ, একেএম সফিউল্লাহ, শাহ আলম, মো. দেলোয়ার হোসেন ও মো. শফিকুল হক।
এর আগে, গত ২৭ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের জন্য এ দিন ধার্য করেন। মামলায় ডেসটিনির প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদ ও এমডি রফিকুল আমীনসহ আসামি ৪৬ জন। এরমধ্যে ৮ জন জামিনে আছেন। কারাগারে পাঁচজন রয়েছেন। এছাড়া অপর আসামিরা পলাতক রয়েছেন। কারাগারে থাকা আসামিরা হলেন- ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল আমীন, চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন, লে. কর্নেল (অব.) মো. দিদারুল আলম, মো. জিয়াউল হক মোল্লা ও সাঈদুল ইসলাম খান (রুবেল)।
আদালতের রায়ে কার কত অর্থদণ্ড
রায়ে রফিকুল আমিনকে ১২ বছর কারাদণ্ড, ২০০ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ডেসটিনির প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান এম হারুন-অর-রশীদকে ৪ বছর কারাদণ্ড, সাড়ে ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ৬ মাস কারাদণ্ড; চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেনকে ১০ বছর কারাদণ্ড, দেড় কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর কারাদণ্ড; উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোফরানুল হক, পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন ও সাঈদ-উর-রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড, ১৮০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে ৯ বছর কারাদণ্ড, ৩০ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ইরফান আহমেদ সানীকে ৯ বছরের সাজা ১৫০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ২ দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ফারাহ দীবা, ইঞ্জিনিয়ার শেখ তৈয়বুর রহমান, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাসকে ৮ বছর করে কারাদণ্ড, ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড দিতে ব্যর্থ হলে তাদের আরও দুই বছর করে কারাভোগ করতে হবে। জমশেদ আরা চৌধুরীকে ৮ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৩৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে তাকে আরো ২ বছর কারাগারে থাকতে হবে।
জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, আকবর হোসেন সুমনকে ৯ বছর কারাদণ্ড, ১২৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আড়াই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, মো. সাইদুল ইসলাম খান রুবেল ও মজিবর রহমানকে ৮ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১২৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আড়াই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সুমন আলী খানকে ৯ বছরের জেল, ১২৫ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো আড়াই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শিরীন আকতার ও রফিকুল ইসলাম সরকারকে ৮ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১২৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও আড়াই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. দিদারুল আলমকে ৮ বছর কারাদণ্ড, ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ড. এম হায়দারুজ্জামানকে ৬ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীনকে ৬ বছর কারাদণ্ড, ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কাজী ফজলুল করিমকে ৫ বছর কারাদণ্ড, ৫০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সফিকুল ইসলামকে সাত বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জিয়াউল হক মোল্লা এবং ফিরোজ আলমকে ৫ বছর করে কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ওমর ফারুককে ৫ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সিকদার কবিরুল ইসলামকে ৫ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সুনীল বরুন কর্মকরকে ৮ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫ কোটি অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ফরিদ আক্তারকে ৮ বছর কারাদণ্ড, আড়াই কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া দিয়েছেন আদালত। এস এম শহিদুজ্জামান চয়নকে ৮ বছরের কারাদণ্ডর পাশাপাশি ১৫ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আব্দুর রহমান তপনকে সাত বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মেজর সাকিবুজ্জামান খানকে ৫ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এস এম আহসানুল কবির বিপ্লব এবং এএইচএম আতাউর রহমানকে ৮ বছর করে কারাদণ্ড, ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জিএম গোলাম কিবরিয়া মিল্টনকে ৮ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে তাকে আরো দুই বছর কারাগারে থাকতে হবে।
আতিকুর রহমানকে সাত বছর কারাদণ্ড, ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। খন্দকার বেনজীর আহমেদ, একেএম সফিউল্লাহ এবং দেলোয়ার হোসেনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড, ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাবাসের রায় দেওয়া হয়েছে। জেসমিন আক্তার মিলনকে ৫ বছর কারাদণ্ড, ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সফিকুল হককে ৭ বছররের কারাদণ্ডের পাশপাশি ১ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মোল্লা আল আমিনকে চার বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে আরো ৬ মাস কারাভোগ করতে হবে। ৪৬ আসামিকে মোট ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
উল্লেখ্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দুটি করেন।
২০১৪ সালের ৪ মে দুদকের উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার গ্রাহকদের চার হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে পাচারের অভিযোগে ডেসটিনির ৫১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলায় ৪৬ জন এবং ডেসটিনি ট্রি প্লানটেশন লিমিটেডে দুর্নীতির মামলার ১৯ জনকে আসামি করা হয়। দুই মামলাতেই আসামি হারুন-অর-রশিদ ও রফিকুল আমিন।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ প্রোজেক্টের নামে ডেসটিনি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল ১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে। ঐ অর্থ আত্মসাতের ফলে সাড়ে ৮ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েন। আর ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন প্রোজেক্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আত্মসাত করা হয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাড়ে ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের নামে ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল নামসর্বস্ব। আসামিরা প্রথমে প্রজেক্টের টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করতেন, তারপর বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে তা স্থানান্তর করা হতো। দুদক ৩৪টি ব্যাংকে এ রকম ৭২২টি হিসাবের সন্ধান পায়, যেগুলো পরে জব্দ করা হয়। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এ মামলায় মোট ৩০৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ২০২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।