সিনেমার কাহিনীকে হার মানানো এই ঘটনাটি – ঘটনাকাল ২০১৯. সালে ! ছবিটি ডা. মৌসুমি সেনের, তিনি হৃদরোগের চিকিৎসক। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মায়ের গর্ভে থাকাকালেই বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। জন্মের পর কখনো বাবাকে দেখেননি, তবু সেই বাবার মঙ্গল কামনা করেন। জন্মদাতা পুরুষটির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর মায়ের সিঁথির সিঁদুর মুছে যাক, তা কখনোই কাম্য নয়। যদিও তাঁর মা কখনো স্ত্রীর স্বীকৃতি পাননি সুজিত কুমার সেনের। তবে খুব ভালোবেসে ছিলেন, এক পর্যায়ে গর্ভে ধারণ করেন মৌসুমিকে। মৌসুমির জন্মদাতা সুজিত কুমার হৃদরোগে আক্রান্ত, অবস্থাটা জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি থাকার মতো। তিনি চট্টগ্রামের নামকরা জাহাজ ব্যবসায়ী। তাঁর হার্টের আর্টারি এমনভাবে ব্লকড, যেন কোনোভাবেই ঠিক করা সম্ভব নয়। দেশের নামকরা বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসার বোর্ড গঠন করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, ‘সুজিত বাবুর বাঁচার সম্ভাবনা নেই।’ হঠাৎ সার্জনদের মধ্যে একজন আশার আলোর জ্বেলে দেয়ার মতো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এক হার্ট সার্জন আছেন, ডা. মৌসুমি। যিনি এ রকম অস্ত্রোপচার (অপারেশন) খুব ভালোভাবে করেন। তিনি কোনো একটা উপায় বের করতে পারেন। বোর্ড সভা থেকেই জ্যেষ্ঠ এক হার্ট সার্জন ডা. মৌসুমির সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন। আমেরিকায় নিজের কক্ষে তখন ল্যাপটপে জরুরি কিছু করছিলেন মৌসুমি। বাংলাদেশি এক সার্জন এক রোগীর জরুরি অস্ত্রোপচার বিষয়ে তাঁর মতামত চাচ্ছেন। ই-মেলে ওই চিকিৎসকের পাঠানো সব তথ্য দেখে ডা. মৌসুমি ভাবছেন, রোগীর হার্টের যে অবস্থা, সার্জারি সম্ভব নয়। এমন কথা জানিয়ে ই-মেলের উত্তর দেবেন মৌসুমি, ঠিক তখন রোগীর নাম, ঠিকানা দেখে চমকে উঠেন। লিখলেন, ‘রোগীর পারিবারিক বৃত্তান্তসহ, ছবি পাঠান।’ কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রোগীর ছবিসহ পরিবারের বৃত্তান্ত অাসে। ই-মেলে আসা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। এই সুজিতই তাঁর জন্মদাতা! ভোরের ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসার টিকিট রাতেই বুকড করেন তিনি। জন্মদাতার অস্ত্রোপচার করবেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকা হয়ে পৌঁছান চট্টগ্রামে। চিকিৎসকদের সঙ্গে সভা, শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, অপারেশন করবেন। যদিও রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। পরের দিন সুজিত সেনের হৃৎপিণ্ডের সার্জারি শুরু। টানা আট ঘণ্টা চেষ্টার পর ‘অপারেশন সাক্সেসফুল’। জ্ঞান ফেরার পর সুজিত সেন ডা. মৌসুমিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি ভগবান। সেই বাবা-মা কতো ভাগ্যবান, যারা আপনাকে জন্ম দিয়েছেন।’ এবার ডা. মৌসুমি বলেন, ‘যদি বলি আপনিই সেই ভাগ্যবান বাবা!’ সুজিত সেন বিষ্ময়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘মানে?’ মৌসুমি বলতে থাকেন, ‘লীলা দেবীর কথা মনে আছে? যাঁকে ভালোবাসার মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ের আগে ভোগ করেছিলেন? তিনি যখন আপনাকে জানালেন, মা হতে চলেছেন, তখন বাচ্চাটাকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই শেষ করে দিতে বলেছিলেন! সেদিন আপনি আমাকে মৃত্যু উপহার দিতে চেয়েছিলেন। আজ আমি আপনাকে জীবন উপহার দিলাম।’ মৌসুমি আরো বলতে থাকেন, ‘ভাববেন না, আপনি আমার বাবা, তাই আমি ছুটে এসেছি। বিদেশ থেকে ছুটে এসেছি, আমার মায়ের জন্য। তিনি এখনো আপনার নামে সিঁথিতে সিঁদুর মাখেন। মায়ের সিঁথি সাদা দেখতে চাই না। মাকে এটাই আমার দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।’