শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় করতে চায় বিএনপি। নমনীয় অবস্থানে থেকে ভোটারদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানানোর প্রতিই বেশি জোর দিচ্ছে দলটি। সাধারণ মানুষকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপী প্রচার চালানো হচ্ছে। ভোটের দিন কোনো ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষে না জড়াতে বিএনপির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি মনে করে, এবার কোন প্রক্রিয়ায় কী ধরনের নির্বাচন হচ্ছে—জনগণের কাছে তা একেবারেই স্পষ্ট। ফলে বিএনপির ভোট বর্জনের আহ্বানে মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দেবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা প্রকাশিত হবে।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে গত বছরের ১৪ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। ধারাবাহিক কর্মসূচির পর গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ ডাকে দলটি। ওই কর্মসূচি কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনার জেরে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারা দেশে নেতাকর্মীরা ব্যাপক ধরপাকড়ের শিকার হন। এই প্রেক্ষাপটে একদফা দাবি আদায়ে চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে ভোট বর্জনের পাশাপাশি সরকারকে অসহযোগের আহ্বানও জানায় দলটি। তবে ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কঠোর অবস্থান থেকে অনেকটা সরে এসেছে বিএনপি। হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি না দিয়ে গত কয়েক দিন ধরে মানুষকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি চলছে। আজ বৃহস্পতিবার পঞ্চম দফার গণসংযোগ কর্মসূচি শেষ হচ্ছে।
জানা গেছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোট বর্জনের আহ্বানে আগামীকাল শুক্রবার ঢাকায় গণমিছিল কিংবা পেশাজীবীদের ব্যানারে সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে বিএনপি ও যুগপৎ শরিকদের। সেটা না হলে ওইদিনও গণসংযোগের মধ্যেই সীমিত থাকতে পারে বিএনপির কর্মসূচি। তবে নির্বাচনের তপশিল অনুযায়ী শুক্রবার সকাল ৮টায় ভোটের প্রচার-প্রচারণার শেষ সময়। ফলে সেদিন ভোটবিরোধী গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করা সম্ভব হবে কি না—সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। অবশ্য ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের দিন থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শুধু ভোটের দিনও হরতাল দেওয়া হতে পারে। তবে এই কর্মসূচিও শুধু ভোট বর্জনের আহ্বান ও একদফা দাবি জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কর্মসূচি যা-ই হোক না কেন—কোনো রকম উসকানিতে পা না দিয়ে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে তা পালন করার জন্য তৃণমূলে কড়া নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘ভোট ঠেকানো কিংবা ভোট প্রতিহত করা বিএনপির আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। বিএনপি এই একতরফা, ডামি নির্বাচন বর্জন করেছে। দেশবাসীকেও এই নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। সেই লক্ষ্যে গণসংযোগমূলক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। জনগণ এরই মধ্যে বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্বাচন ঘিরে কী হচ্ছে তা শুধু দেশের জনগণই নয়, আন্তর্জাতিক তথা গণতান্ত্রিক বিশ্বও ওয়াকিবহাল। বিএনপি এই নির্বাচনী প্রহসন বর্জন করেছে। বিএনপি ভোট বর্জনের যে আহ্বান জানিয়েছে, তা অব্যাহত রাখবে। নির্বাচনের দিন ঘিরে বিএনপি যে কর্মসূচি দেবে সেটিও শান্তিপূর্ণ আহ্বানের মধ্য দিয়ে পালিত হবে।’
এদিকে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে সংঘটিত নাশকতার ঘটনায় গত রোববার জাতিসংঘসহ ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে দলটি। ইমেইলে পাঠানো সাত পৃষ্ঠার এই চিঠিতে সম্প্রতি সংঘটিত অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতার জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। দলটির দাবি, ‘জনসম্পৃক্ত চলমান আন্দোলন নস্যাৎ করতে সরকারি মদদে বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর তার দায় চাপানো হচ্ছে। তবে এসব অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে কারা ঘটিয়েছে—তা দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওয়াকিবহাল বলে মনে করে বিএনপি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে দাবিতে আন্দোলন করছে। এই দাবি অত্যন্ত ন্যায্য এবং এতে সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে। গণমানুষের দাবি আদায়ে বিরোধী দলগুলো কেন সহিংসতা ঘটাবে? বিরোধী দলগুলো অত্যন্ত সচেতনভাবে সহিংসতা পরিহার করে জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুরোপুরি অহিংস আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। কর্মসূচি ঘিরে যে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে, রাষ্ট্রীয় মদদে সেটা ঘটেছে। এরপর বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর তার দায় চাপিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার যে অপতৎপরতা, শুরু থেকেই আমরা এই সুযোগ সরকারকে দিইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি উসকানি, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে সর্বোচ্চ সংযম দেখিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেদিকে লক্ষ্য রাখছে। ফলে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের প্রতি নিশ্চয় তাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তা ছাড়া ৭ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের প্রতিও পশ্চিমা বিশ্বের মনোযোগ রয়েছে। ফলে আমাদের ধারণা, একতরফা ভোটের পর পরই নির্বাচন ও সরকারের বিষয়ে তারা তাদের মনোভাব-অবস্থান পরিষ্কার করবেন। সেদিক থেকে মনে করি, এটা বিরোধী দলগুলোর জন্য নৈতিক বিজয়।’