“জীবনযৃুদ্ধে এক অপরাজিত সৈনিক কবি শওকত আলম” শুরুতেই ডা. লুৎফর রহমানের একটা বাণী মনে পড়ে গেল তা হলো- জীবনের মালিক তুমি, দুঃখ বেদনা ও অভাবকে বাঁধা মনে না করে সেগুলোকে আর্শীবাদ মনে করে ধরে নাও। কিছুই তোমার গতিকে রোধ করতে পারবে না। যেমন করে হোক তুমি বড় হবেই। বুক ভেঙ্গে গেছে ভয় নাই।ভাঙ্গা বুক নিয়ে আল্লাহ ভরসা করে দাঁড়াও। মানুষ মাত্রই সংগ্রামশীল বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী। আজ আমি যে মানুষটির জীবন কাহিনী আলোচনা করবো তিনিও একজন সংগ্রামী মানুষ।বৈচিত্র্যময় তার জীবন।নেশায় তিনি একজন কবি, পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। হ্যা আমি কবি শওকত আলমের কথা বলছি। ১৯৭৩ সালের ৫ কার্তিক ২০ শে অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার অন্তর্গত গাবুরা (খোলপাটুয়া) গ্রামের সরদার বাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। নানান ঘাত প্রতিঘাতের কারণে পরিবারটি তখন অর্থনৈতিক ভাবে বিধ্বস্ত। নিদারুণ দারিদ্রতার অক্টোপাসের জালে বন্দি। শওকত আলমের বয়স যখন সাত আট বছর তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েন। সে সময় তার জীবনে ঘটে যায় এক চরম বিপত্তি। অর্থাৎ এ সময় তার আব্বা আবুল কাশেম লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮০ সালে ২ রা রমজান মাসে ডুমুরিয়া উপজেলা চুকনগর বাজারে ইন্তেকাল করেন। সংসারে নেমে আসে অমাবস্যার অন্ধকার। তার মা আপিরুন্নেছা (নেনী) সংসারের হাল ধরেন। পরের বাড়িতে কাজ করে, এমন কি মাঝে মাঝে কঠোর পরিশ্রমও করতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে। তবুও তার চোখে ছিল এক সমুদ্র স্বপ্ন। সন্তানদের তিনি লেখাপড়া শেখাবেন। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে শত দারিদ্রতার মাঝেও শওকত আলম লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। অভাবের কারণে তিনি ঘর ছড়লেন। জীবনের দীর্ঘ ১২ টি বছর শওকত আলম লজিং থেকেছেন। এর মধ্যে ৩৫টি বাড়ির মালিক তাদের মেয়েকে বিয়ের জন্য শওকতকে প্রস্তাব দেন।তিনি সবিনয়ে তা প্রতাখ্যান করেন এবং এভাবেই তাকে এ বাড়ি ও বাড়ি লজিং থাকতে হয়েছে। তখন তার একটাই স্বপ্ন ছিল,তাকে লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। মায়ের দুঃখ দূর করতে হবে।মাকে তিনি ভিষণ ভালোবাসতেন। মায়ের অনন্ত তিনি কয়েকটি স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তিনি এম.এ পাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি খুলনা হোমিও প্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে ডি.এইচ.এম.এস, এবং খুলনা আইন মহাবিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ডিগ্রীও অর্জন করেছেন। শওকত আলমের আজকের এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশী অবদান যিনি রেখেছেন, তিনি হলেন তার মা আপিরুন্নেছা নেনী বেগম। কবি শওকত আলমের জীবনটা ব্যথা আর বেদনায় ভরা।১৯৭৭ সালে তাকে আব্বা আম্মার সঙ্গে শ্রেফ অর্থনৈতিক কারণে জন্মভূমি গাবুরা ছেড়ে চলে আসতে হয় ডুমুরিয়া উপজেলা নরনিয়া গ্রামে।এখানে এসে তার আশ্রয় হয় সরদার বাড়িতে। কবি শওকত আলম ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।এই রাজনীতি করতে গিয়েও তাকে বহুবার ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে পড়তে হয়। এমন কি কয়েকবার তার জীবনটা হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু সেই হুমকির মধ্যে থেকেও তিনি বেরিয়ে এসেছেন। বেরিয়ে তো আসবেনই, কারণ তার সাথে ছিল তার মায়ের অসীম দোয়া। তিনি এক সময় ছিলেন সত্যের পথের পথিক এক সৈনিক। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।সে কণ্ঠস্বরে আছে বজ্রের মতো তেজস্বিতা। প্রত্যেক মানুষের জীবনে প্রেম আসে। প্রেম হীন মানুষ পৃথিবীতে আছে এ কথা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়। ১৯৩৬ সালের ১২ ই ডিসেম্বর ব্রিটেনের অষ্টম এডওয়ার্ড তার এক রেডিও বক্তৃতায় বলেছিলেন “যে নারীকে আমি ভালোবাসি তার সাহায্য সমর্থন ছাড়া আমি যেমনটি চাই তেমনিভাবে নৃপতিরুপে আমার দায়িত্বের গুরুভার বহন এবং আমার কর্তব্য পালন আমার সাধ্যের অতীতে বলে আমার মনে হয়েছে।” আর লিউওয়ালাম বলেছেন ” প্রেমের সুখ হলো কর্মেঃ অপরের জন্য কাজ করার ইচ্ছাই ভালোবাসার প্রমান।” কবি শওকত আলমের জীবনেও প্রেম এসেছে ফাগুণ ধারার মতো। সেই ১৯৮৮ সালে যখন তিনি মাধ্যমিক পাস করেছেন তখন একটি মেয়ে এসে তার হৃদয়টাকে চুরি করেছিল। তিনি সে প্রেমে সাড়াও দিয়ে ছিলেন। দীর্ঘ আট বছর চলেছিল সে প্রেম। কিন্তু নানা কারণে সেই মেয়েকে তিনি জীবন সাথী হিসেবে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমনি ব্যর্থ হয়েছিল কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ব্যর্থ হয়েছিলেন ভিক্টর নাগাসহ আরো অনেকে। প্রেমে ব্যর্থতা আছে বলেই কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ” “বড় ভালোবাসা শুধু কাছে টানে না, দূরেও সরিয়ে দিতে জানে।” কবি শওকত আলম বিয়ে করেছেন অন্য এক মেয়েকে। বিয়ের আগে প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু হয়নি। হয়তো এখানে বাঁধসেধেছে চরম দারিদ্রতা। তার স্ত্রী লাকী আলম তার দারিদ্রতাকে মেনে নিয়েই তার কষ্টের ভাগীদার হতেই তার সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল। তিনি তার দারিদ্রতাকে ভয়পাননি ; কারণ তিনি জানতেন কাজী নজরুল ইসলামের সেই বাণীটি তা হলো – ” হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান কন্টক মুকুট শোভা।” কবি শওকত আলম বর্তমানে বটিয়াঘাটা উপজেলা ৭নং আমীরপুর ইউনিয়নের বাইনতলা বাজারে বসবাস করছেন। এখানেই তিনি তার চিকিৎসক পেশার চেম্বার করেছেন। তার শ্বশুরও তাকে ডুমুরিয়ার টিপনা সেতুর কাছে রসুপুরে ৪২ শতক জায়গা দিয়েছেন। সেখানে বাড়ির আছে। কিন্তু সেখানে তিনি যাননি। আর তার আব্বার কাছ থেকে তিনি যে জায়গা পেয়েছিলেন তা তিনি একটি মসজিদে দান করে দিয়েছেন। কর্মজীবনে তিনি গ্রন্হ প্রকাশের জন্য যে টাকা সংগ্রহ করে ছিলেন তার সমুদয় অর্থ মসজিদে টাইস এবং একটি টিউবওয়েল বসানোর নিমিত্তে দান করেন। কারণ তিনি আল-কোরআনের মহান সেই বাণীটি স্মরণ করেন, তা হলো ” যারা সম্পাদ বিপদে দান করে,রাগ দমন করে, লোকদের ক্ষমা করে, আল্লাহ এমন হিতাকারীদের ভালোবাসেন। ” কবি শওকত আলম’র জীবন আজ হীরক জ্যোতিময় না হলেও স্বর্ণ উজ্জ্বল তো বটেই। তার এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে শান্ত নদীর স্রোতের মতো ঘাতপ্রতিঘাতের গতিবেগে বয়ে চলেছে সম্মুখপানে। সেখানে বিলাসিতা হয়ত নেই কিন্তু আছে অফুরন্ত সুখ। দুঃখ যে একেবারে নেই তা বলবো না, তবে সে দুঃখকে জয় করে সেখানে প্রবাহিত করতে পেরেছেন সুখের বারিধারা। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে তার পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় এবং মায়ের দোয়ার কারণে, মায়ের দোয়া তার সাথে|
এম, হেফজুর রহমান