সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর মধ্যস্থতায় সৌদি আরবে নিহত দুই বাংলাদেশি পরিবারের অনুকূলে ক্ষতিপূরণের প্রায় ৩০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। রাষ্ট্রদূতের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং মধ্যস্থতায় ২০০৬ সালে দাম্মামে নিহত সাগর পাটোয়ারীর পরিবারকে ৫১ লাখ সৌদি রিয়াল এবং ২০১৯ সালে রিয়াদে নিহত আবিরণের পরিবারকে ৪৮ লাখ ৮০ হাজার সৌদি রিয়াল ক্ষতিপূরণ বাবদ বিতরণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানার সাগর পাটোয়ারী ২০০৬ সালের ৬ জুন অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে দাম্মাম শহরে নিহত হন। দীর্ঘসময় আততায়ীকে শনাক্ত করতে না পারায় যথাসময়ে মামলাটির অগ্রগতি হয়নি।
গত ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট শ্রমকল্যাণ উইং প্রতিনিধি দাম্মাম দক্ষিণ থানায় পরিদর্শনকালে জানতে পারেন সেখানে একটি চুরির মামলায় সৌদি নাগরিক উমর আল শাম্মেরি আটক আছেন যিনি সাগর পাটোয়ারি হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন।
থানা হতে জানানো হয়, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ উমরকে বিবাদী করে মামলা করলে এই বিষয়ে পুনঃতদন্ত করা হবে। এর প্রেক্ষিতে নিহত সাগরের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অজ্ঞাত বিভিন্ন লোকের সহযোগিতায় তার পরিবারের ফোন নম্বর সংগ্রহের মাধ্যমে দূতাবাসের অনুকূলে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে রাষ্ট্রদূতের দিকনির্দেশনায় শ্রম কল্যাণ উইংয়ের প্রতিনিধি বিজ্ঞ আদালতে অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ডের দাবী জানিয়ে অভিযোগ দাখিল করেন।
বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আদালত ২০২১ সালের ২৪ মার্চ তারিখে অভিযুক্ত উমর আল শাম্মেরির বিরুদ্ধে শিরচ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন।
অভিযুক্তের পিতা অর্থের বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডের দাবী প্রত্যাহারের আপোস প্রস্তাব করলে রাষ্ট্রদূতের মধ্যস্থতায় ৫১ লাখ রিয়ালের আপোস প্রস্তাবে নিহত সাগর পাটোয়ারীর ওয়ারিশগন সম্মত হন।
বিজ্ঞ আদালত অভিযুক্তের পরিবারের নিকট থেকে রক্তপণের চেক (নং-১৯৭৩৪৫৯৭) গ্রহণ করে মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করেন। ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর দাম্মামস্থ সৌদি ফ্রান্সি ব্যাংকের ফয়সলিয়া শাখা মারফত দূতাবাসের ব্যাংক হিসাবে ৫১ লাখ রিয়াল জমা হয়।
অন্যদিকে খুলনার পাইকগাছার গৃহকর্মী মোসা. আবিরণ বেগম ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ রিয়াদের আজিজিয়াস্থ নিয়োগকর্তার বাসভবনে গৃহকর্ত্রী আয়েশা আহমাদ সগির আল জিজানি কর্তৃক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আজিজিয়া পুলিশ গৃহকর্ত্রী আয়েশা আল জিজানী, গৃহকর্তা বাসেম সালেম সগির এবং তাদের পুত্র ওয়ালিদ বাসেম সালেমকে গ্রেপ্তার করেন। দীর্ঘ বিচারকার্য শেষে
২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞ আদালতের ৩ সদস্য বিশিষ্ট বিচারক বেঞ্চ প্রধান আসামি গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে কেসাস (জীবনের বিনিময়ে জীবন) এবং অন্যান্য আসামীদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে করাদন্ড ও ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল অর্থদণ্ড প্রদান করে মামলার রায় ঘোষণা করেন।
উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের হলে বিজ্ঞ আপিল আদালতের ৫ সদস্য বিশিষ্ট ফুল বেঞ্চ কেসাস বা মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পরিবার ও সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে আসামিকে ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ জানানো হলে নিহতের পরিবার সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে আসামিদেরকে ক্ষমার সম্মতি প্রদান করে রাষ্ট্রদূত বরাবর আবেদন করেন।
সৌদি আরবে সর্বনিম্ন রক্তপণ ৩ লাখ সৌদি রিয়াল হলেও রাষ্ট্রদূতের প্রচেষ্টায় নিহতের পরিবার ৪৮ লাখ ৮০ হাজার সৌদি রিয়াল রক্তপণ পরিশোধের বিনিময়ে ক্ষমা করতে সম্মত হয়।
অভিযুক্তের পরিবার বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রক্তপণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রদূতের নির্দেশে কাউন্সেলর (শ্রম) রিয়াদের ডেপুটি গভর্ণর নাবিল বিন আব্দুল্লাহ আল-তাওয়ীল এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বিজ্ঞ বিচারক গত ২০২৩ সালের ১৫ মে তারিখে প্রধান আসামির হত্যার রায় বাতিল করে আপোস অনুযায়ী নিহত মোসা. আবিরণ বেগমের বৈধ ওয়ারিশগণের নামে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪৮ লাখ ৮০ হাজার সৌদি রিয়াল ক্ষতিপূরণের চেক ইস্যু করেন এবং সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পর তা দূতাবাসের অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর সাগর পাটোয়ারী এবং আবিরণ হত্যা মামলায় সৌদি আরবে কোন বাংলাদেশির অনুকূলে সর্বোচ্চ ব্লাডমানি আদায় হওয়াতে নিহতের পরিবার সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মরত সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তদুপরি এ মধ্যস্থতার ফলে একজন সৌদি নাগরিকের প্রাণ বেঁচে যাওয়ায় সৌদি সরকার এবং নিহতের পরিবার সন্তোষ প্রকাশ করেন।