অধ্যাপক শাহজাহান আলী ছিলেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ। নানা কারণে বিতর্কিত এ অধ্যক্ষকে গেল ২২ অক্টোবর শাস্তিমূলক বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। বদলির ওই আদেশে ৫ নভেম্বরের মধ্যে অধিদপ্তরে যোগ দেওয়ার নির্দেশনাও ছিল। সে অনুযায়ী অধ্যাপক শাহজাহান ৫ নভেম্বর বিকেলে আজিজুল হক কলেজ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেন। তবে বিদায়ের পরও সচল ছিল তাঁর কেরামতি! আজিজুল হক কলেজে কাগজে-কলমে না থাকলেও তাঁর সইয়ে ‘বাস তহবিল’ থেকে ঠিকই চারটি চেকের মাধ্যমে তোলা হয়েছে টাকা। এর মধ্যে ৯ নভেম্বর ১ লাখ ৭৪ হাজার ৩৮৪, ১২ নভেম্বর তিনটি ঢেকে ১৪ হাজার ৪০০, ১১ হাজার ৮৯৭ এবং ১৬ হাজার ৯২১ টাকা রয়েছে।
এমন আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে সমকাল। সোনালী ব্যাংকের আজিজুল হক কলেজ শাখার ‘গভর্নমেন্ট আজিজুল হক কলেজ বগুড়া বাস অ্যাকাউন্ট’ নামে 060210001৩৭৩৬ নম্বর ব্যাংক হিসাবটি পর্যালোচনা করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। মেলে পরিবহন খাতের অস্বাভাবিক চিত্র। করোনার সময় কলেজ বাস না চললেও ঠিকই লেনদেন হয় বিল। ২০১৮ সালের শুরু থেকে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের এ হিসাব থেকে তোলা হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার দুই বছর তোলা হয় ৫৫ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি অধ্যাপক শাহজাহান আলী কলেজে যোগ দেওয়ার পর তাঁর আস্থাভাজনদের দিয়ে সাজান প্রশাসন। তাঁর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আরবি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুর রশিদকে করা হয় পরিবহন কমিটির আহ্বায়ক। এর পর শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বাধ্যতামূলক টাকা আদায় করে চলে হরিলুট। তবে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েও নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন সেবাবঞ্চিত করা হয় তাদের।
করোনায় তামাম বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রা থমকে গেলেও আজিজুল হক কলেজের বাস তহবিলের টাকা লেনদেনে ছেদ পড়েনি। ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে করোনা ছোবল বসায়। সরকারি সিদ্ধান্তে ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বিকল্প হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রম ১৮ মাস চলে অনলাইনে। এ সময় কলেজের ছয়টি বাস গ্যারেজে অলস পড়ে থাকলেও ওই বছর ৩৫ লাখ টাকা তোলা হয়। ২০২১ সালে তোলা হয় ২০ লাখ টাকা।
করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চে ৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, এপ্রিলে ৪ লাখ ৬৭ হাজার, মে মাসে ৩ লাখ ২৩ হাজার, জুনে ২ লাখ ২১ হাজার, জুলাইয়ে ১ লাখ ৯ হাজার, আগস্টে ১ লাখ ৩৭ হাজার, সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ২০ হাজার, অক্টোবরে ৩ লাখ ৩ হাজার, নভেম্বরে ১ লাখ ৯৫ হাজার ও ডিসেম্বরে ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা তোলা হয়।
কলেজের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে থেকে বছরে বাধ্যতামূলক ২৭৫ টাকা করে আদায় করা হয়। এ হিসাবে ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে আদায় হয় ৭৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্র-শনিবারসহ সরকারি ছুটি বছরে ১০৪ দিন। বিভিন্ন পরীক্ষার কারণে বছরে ক্লাস বন্ধ থাকে ৪৫ থেকে ৫০ দিন। অতিরিক্ত আরও ছুটি থাকে ৫ থেকে ১০ দিন। সবকিছু বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিবহন সেবা দেওয়া হয় বছরে ১২৫ থেকে ১৩০ দিন। বর্তমানে সারিয়াকান্দি, মোকামতলা, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া, শেরপুর ও নামুজা রোডে বাসগুলো চলাচল করে। তবে চেলোপাড়া এলাকায় করতোয়া নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় সারিয়াকান্দি পথের গাড়ি চলাচল অনেক দিন বন্ধ। কলেজ থেকে এই রুটগুলোর গড় দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। সে ক্ষেত্রে আসা-যাওয়া মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার পথ চলাচল করতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাসচালক বলেন, ৩ কিলোমিটার বাস চলতে ১ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার পথ চলতে ১৬ লিটার তেলের প্রয়োজন হবে। ছয়টি বাসে একই পরিমাণ তেল হিসাব করলে লাগে ৯৬ লিটার। বর্তমান ১০৯ টাকা দাম হিসাবে ১০ হাজার ৪৬৪ টাকা লাগে। ১৩০ দিনের পরিবহন তেল খরচ লাগার কথা ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সার্ভিসিং ও মবিল বাবদ ছয় গাড়িতে আরও ৬ লাখ টাকা ধরলেও বছরে মোট খরচ ১৯ লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর এত বিপুল পরিমাণ টাকা খরচের ঘটনা হরিলুটের পর্যায়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে সারিয়াকান্দি দেবডাঙ্গার শিক্ষার্থী আজাদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার সময় আমরা বাসে না চললেও ফি দিয়েছি। বছর বছর আমরা বাস ফি দিই। তবে বাসই আমাদের রুটে ঠিকমতো আসে না।’
অতিরিক্ত টাকা তোলার ব্যাপারে বাস কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আব্দুর রশিদ বলেন, করোনাকালে কলেজ বাস বসে ছিল, তাই তখন গাড়ি মেরামতের সুযোগ পেয়েছি। তবে করোনার দুই বছরে ৫৫ লাখ টাকা খরচের ব্যাপারটি তিনি অস্বীকার করেন।
সদ্য বদলি হওয়া অধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহজাহান আলী বলেন, করোনার সময় বাস না চললেও গাড়ি মেরামত ও সার্ভিসিং করতে হয়েছে। এ কারণে ওই সময় ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তাঁর সময়ে বাস তহবিল থেকে সবচেয়ে কম টাকা খরচ করা হয়েছে। তিনি দায়িত্ব হস্তান্তরের সময়ও এ তহবিলে অনেক টাকা রেখে এসেছেন।
ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদে অধ্যাপক
এদিকে তথ্য গোপন করে ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দিয়ে সরকারি চাকরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে। ১৬তম বিসিএসের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের ১০ আগষ্ট প্রভাষক পদে যোগ দেন তিনি। এই পদে যোগ দেওয়ার আগে একই বছরের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) প্রকাশিত সংযুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সুযোগ নিতে ১০ শতাংশ কোটায় সরকারি অধ্যাপক (গণিত) পদের জন্য আবেদন করেন। আবেদনে বর্ণিত প্রথম শ্রেণির সম্মানসহ দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং যে কোনো ডিগ্রি কলেজ থেকে ছয় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করে ১৯৯৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সহকারী অধ্যাপক পদে সরাসরি নিয়োগ পান।
তাঁর এক সহপাঠী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শাহজাহান ঢাকার মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি কলেজে চাকরি করেছেন। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার সনদ ওই কলেজ থেকেই নিয়েছেন, যা সম্পূর্ণ ভুয়া। তার অভিজ্ঞতা তখন পুরো ছয় বছর পূর্ণ হয়নি। ফলে সরকারি বিধি অনুযায়ী এই সনদের কোনো বৈধতা নেই।
অধ্যাপক শাহজাহান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালের ১৩ মে গণিতে মাস্টার্স করেন। পিএসসির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ থেকে তাঁর মাস্টার্স পাসের তারিখ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান পাঁচ বছর আট মাস তিন দিন। একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর চাকরির আবেদন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ন্যূনতম ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। অথচ তিনি ছয় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার যে সনদ দিয়েছেন, তাতে প্রায় চার মাসের ঘাটতি ছিল।
অভিজ্ঞতা সনদ কোন প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছেন জানতে চাইলে অধ্যাপক শাহজাহান আলী বলেন, এটি আমি পিএসসিতে জমা দিয়েছি। এটা অন্য কারও কাছে বলতে বাধ্য নই।
অবশেষে ওএসডি
অধ্যাপক শাহজাহান আলী আজিজুল হক কলেজে থাকাকালে জ্যেষ্ঠ নারী সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে ওএসডি হিসেবে অধিদপ্তরে যুক্ত হন।