মহাস্থান নিউজ:
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বেগুন জোয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা স্কুলে যান না। তবে স্কুলের হাজিরা খাতায় নিয়মিত উপস্থিতি দেখাতে স্বাক্ষর করেন। গত ছয় বছর থেকে মাসে ২-৩ বার স্কুলে গিয়ে পুরো সপ্তাহের একবারে স্বাক্ষর করেন। আবার কখনো সহকারি শিক্ষক ও অফিস সহকারির মাধ্যমে হাজিরা খাতা বাসায় নিয়ে গিয়ে স্বাক্ষর করেন। আর এভাবেই সরকারি কোষাগার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে পাপিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে। একই বিদ্যালয়ের স্বামী আবু সাদাত শামীম আহমেদ প্রধান শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আ.স.ম শফি মাহমুদ এর ছত্রছায়ায় অনিয়মের সুযোগ পেয়েছেন এমন অভিযোগ শিক্ষক ও এলাকাবাসীর।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৮৫ জন। এছাড়া শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৫ জন। গত ২০১৪ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন পাপিয়া সুলতানা। যোগদানের পাঁচমাস পর কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব ও আর্থিক অনিয়মের কারণে তাকে দেড় বছর স্কুলের বাহিরে থাকতে হয়েছিল। পরবর্তীতে পকেট কমিটি গঠন করে আবার স্কুলমুখী হোন তিনি। তবে তিনি নিয়মিত স্কুলে যান না। মাসে ২-৩ দিন স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতায় পুরো সপ্তাহের স্বাক্ষর করে চলে আসেন। স্কুলে নিয়মিত না আসায় শিক্ষার্থীরা তাকে চিনে না। কিন্তু মাস শেষে বেতন বিলের কাগজে পুরো মাসের স্বাক্ষর থাকে। সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরে বেতন উঠে। নিয়মিত স্কুলে না গিয়ে সরকারি কোষাগার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন পাওয়া বা উত্তোলন করায় সহকারি শিক্ষক সহ এলাকাবাসীরা বিষয়টি নিয়ে ক্ষিপ্ত।
এক মাস আগেও প্রধান শিক্ষকের ভয়ে স্কুলের সহকারি শিক্ষকরা ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতো না। কিন্তু গত ৫ জুলাই প্রধান শিক্ষক আবু সাদাত শামীম আহমেদ ও একই স্কুলের সহকারি শিক্ষিকার বিরুদ্ধে অফিস কক্ষে অসামাজিক কর্মকান্ডের অভিযোগে এ দুই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
চলতি মাসের ১ আগষ্ট পাপিয়া সুলতানা স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। পরে এলাকাবাসীর তোপেরমুখে পড়ে স্কুল থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। এরপর তিনি আর স্কুলে যাননি। তার স্বাক্ষরের জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। গত জুলাই মাসে ঈদের ছুটি থাকায় ১০ তারিখে স্কুল চালু হয়। তিন দিনের স্বাক্ষর একবারে করেছেন। এরপর ১৩ তারিখ থেকে পরবর্তী তারিখগুলো ফাঁকা রয়েছে। ফাঁকা ঘরে যেন স্বাক্ষর করতে না পারে জন্য শিক্ষা অফিসার সেখানে লম্বা করে টান টান দিয়ে রেখেছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির কয়েজন শিক্ষার্থী জানায়, এ পর্যন্ত সহকারি প্রধান শিক্ষিকা ম্যাডামকে তিনদিন স্কুলে আসা দেখেছে। তার একটা ক্লাসও করেছি। তারপর আর দেখা হয়নি।
অফিস সহকারি আবু সাঈদ বলেন, সহকারি প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা নিয়মিত স্কুলে আসেন না। আবার যখন স্কুলে আসেন পুরো মাসের অনুপস্থিতির জায়গায় মাসজুড়ে একবারে স্বাক্ষর করতেন। অনেক সময় আমাকে এবং সহকারি শিক্ষক জামিল হোসেন সহ উপস্থিতি খাতায় নওগাঁ শহরের তাদের বাসায় নিয়ে গিয়ে স্বাক্ষর করাতে হতো। যদি আমাদের বেতন আটকিয়ে দেয় এই ভয়ে আমরা কিছু বলতে পারতাম না।
বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মিঠুন কুমার, শাহনাজ সুলতানা, জুয়েল হোসেন ও মঞ্জুরুল আলম বলেন, সহকারি প্রধান শিক্ষিকার স্বামী আমাদের প্রধান শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক এলাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। এ কারণে তার স্ত্রী সহকারি প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা স্কুলে আসেন না। তবে মাঝেমধ্যে আসেন এবং পুরো মাসের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। এছাড়া বেতন শিটে পুরো মাসের উপস্থিতি দেখিয়ে বেতন উত্তোলন করেন। স্কুলে না আসলেও তার বেতন বন্ধ থাকে না। কিন্তু আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না। স্কুলে যে অপ্রীতিকর ঘটনার উদ্ভুত পরিস্থিতি হয়েছে সভাপতি এখন পর্যন্ত আসেননি। পকেট কমিটি গঠন করে এসব অনিয়ম করা হচ্ছে।
স্থানীয় সোহেল রানা মিঠু বলেন, ম্যানেজিং কমিটি, প্রধান শিক্ষক ও সহকারি প্রধান শিক্ষিকাকে আমরা চাইনা। নতুন মুখ দেখতে চাই। এতে স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে।
গত প্রায় ৫ বছর থেকে পরিবার সহ নওগাঁ শহরে বসবাস করছেন প্রধান শিক্ষক আবু সাদাত শামীম আহমেদ ও তার স্ত্রী সহকারি প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা। তাদের গ্রামের বাড়িতে পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য জানতে আবু সাদাত শামীম আহমেদ এর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। স্কুলের বিষয়ে মন্তব্য জানতে এ প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি।
এদিকে পাপিয়া সুলতানার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। অবশেষে এ প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আ.স.ম শফি মাহমুদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষক ও এলাকাবাসীরা ক্ষিপ্ত। প্রায় ৫ বছর থেকে স্কুলের সভাপতির দায়িত্বে আছেন তিনি। বর্তমান যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তার সময় প্রায় দেড় বছর। এ সময়রে মধ্যে তিনি কখনো স্কুলে যান না। প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষিকার অপ্রীতিকর ঘটনার উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি স্কুলে যাননি। এমনকি স্কুলের কোন বিষয়ে আলোচনাও (মিটিং) হয়না।
এ বিষয়ে সভাপতি আ.স.ম শফি মাহমুদ বলেন, স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত মিটিং করা হয়। সহকারি প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা অসসুস্থতার কারণে তিনি মাঝেমধ্যে স্কুলে যেতেন না। বিষয়টি সাধারণ শিক্ষকরাও মেনে নিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক বেতন বিল তৈরি করেন আর আমি স্বাক্ষর করি। তবে বেতন শিটে পুরো মাসের উপস্থিতি দেখিয়ে স্বাক্ষর করা হয়। অনুপস্থিত থাকার পরও বেতন শিটে কিভাবে পুরো মাসের উপস্থিতি দেখিয়ে বেতন উত্তোলন করা হয় এ দায়ভার আপনার (আ.স.ম শফি মাহমুদ) আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি এড়িয়ে যান।
বদলগাছী সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শেখ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা জানি সহকারি প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা নিয়মিত স্কুলে যান। পরিদর্শনেও তার প্রমান রয়েছে। কারণ হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষর থাকায় আমরা বুঝবো তিনি নিয়মিত স্কুলে যান। এছাড়া বেতনের বিষয়টি প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির স্বাক্ষরে হয়। আমরা শুধু দেখবো হাজিরা খাতায় উপস্থিত আছে কিনা। যদি তিনি স্কুলে অনিয়মিত হয় তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।