মহাস্থান নিউজ:
(লাব্বাইক্ আল্লাহুম্মা লাব্বাইক্ লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক্ ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক্ লা-শারীকা লাক্)
হজ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- ইচ্ছা করা, দৃঢ়সংকল্প করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায়, মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট কার্যাবলী সম্পাদন করাকে হজ বলে।
হজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি, যা স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস অকুণ্ঠ ভালবাসা ও পূর্ণ আনুগত্যের প্রতীক। স্রষ্টার সঙ্গে বান্দার ভালোবাসার পরীক্ষার চূড়ান্ত ধাপ হল হজ। জিয়ারতে বাইতুল্লার মাধ্যমে খোদাপ্রেমিক মুমিন বান্দা তার মালিকের বাড়িতে বেড়াতে যায়, অনুভব করে দিদারে এলাহির এক জান্নাতি আবেশ। কলুষমুক্ত হয় গুনাহের গন্ধে কলুষিত অন্তরাত্মা। হজের মাধ্যমে মুমিনের আত্মিক, দৈহিক ও আর্থিক ইবাদাতের সমাবেশ ঘটে। প্রত্যেক সামর্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ এবং এর অস্বীকারকারী কাফের।
মহান আল্লাহ তা’আলা এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য; যার সামর্থ্য রয়েছে বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে এটা অস্বীকার করবে- আল্লাহ বিশ্বজগতের সব কিছু থেকে অমুখাপেক্ষী।’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ৯৭)।
মহান আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে আরো ইরশাদ করেন, ‘আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা করুন। তারা আপনার কাছে আসবে দূর-দূরান্ত থেকে পদযোগে ও সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে আরোহণ করে।’ (সূরা হজ, আয়াত:২৭)।
প্রিয় পাঠক! এখানে সামর্থ্য বলতে শারীরিক ও আর্থিক উভয় প্রকার সামর্থ্য বোঝানো হয়েছে। সুতরাং সামর্থ্যবান হলে সকল প্রকার বাধা- বিপত্তি, দ্বিধা-সংশয় ও ভ্রান্ত ধারণা ছেড়ে দিয়ে অনতিবিলম্বে হজ আদায় করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ফরজ হজ আদায়ে বিলম্ব করো না। কেননা তোমাদের জানা নেই, পরবর্তী জীবনে তোমরা কী অবস্থার সম্মুখিন হবে।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৮৬৭)।
আর সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও যারা হজ না করে মারা যায়, বিচার দিবসের একমাত্র সুপারিশকারী মহানবী (সা.) তাদের ব্যপারে অত্যন্ত শক্ত মনোভাব পোষণ করেছেন। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও যে হজ না করে মারা যায়, সে ইয়াহুদী হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে মারা যাক, তাতে আমার কোনো পরোয়া নেই।’ (তিরমিযি: ৮১২)।
পক্ষান্তরে যারা মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে হজ আদায় করে, মহানবী (সা.) তাদের ব্যাপারে গুনাহ মাফ ও জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এমনভাবে হজ আদায় করল যে, কোনোরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়নি, সে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে।’ (বুখারি: ১৫২১)।
প্রিয় পাঠক! এ হাদিসটি গবেষণা করলে জানা যায় যে, মহানবী (সা.) হজের মাধ্যমে ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য বিশেষভাবে তিনটি শর্ত আরোপ করেছেন:
১. হজের লক্ষ্য হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
২. হজের সফরে অশ্লীল বাক্যালাপ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
৩.হজের সফর অবস্থায় সকল প্রকার গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রিয়নবী (সা.) আরো ইরশাদ করেন, ‘হজ ও উমরাকারীগণ হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার মেহমান, তারা যদি আল্লাহর নিকট দুআ করে, তবে তিনি তা কবুল করেন। আর যদি তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।’ (ইব্নে মাযাহ্: ২৮৯২)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হজ্জে মবরূর তথা মকবুল হজের প্রতিদান হলো জান্নাত।’ (বুখারি: ১৭৭৩)। হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো হাজী সাহেবের সাথে তোমাদের সাক্ষাত হলে তাঁকে সালাম করবে, তাঁর সাথে মুসাফাহ্ করবে এবং তিনি নিজ গৃহে প্রবেশের পূর্বে তার নিকট দুআ কামনা করবে। কারণ তিনি নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এসেছেন।’ (ইবনে মাযাহ: ৩০০৪)।
ফতোয়ায়ে শামিতে উল্লেখ করা হয়েছে, হজের ফরজ তিনটি: এক. ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ হজের নিয়তে ইহরামের কাপড় পরিধান করে তালবিয়াহ পাঠ করা। দুই. আরাফার ময়দানে অবস্থান (যা হজের সর্বোত্তম রুকন)। তিন. তাওয়াফে জিয়ারত। এগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ছুটে গেলে হজ বাতিল হয়ে যাবে।
আর হজের ওয়াজিব ছয়টি: এক. মুযদালিফায় অবস্থান। দুই. কঙ্কর নিক্ষেপ। তিন. কোরবানি করা। চার. মাথা মুন্ডানো বা ছাটা। পাঁচ. সাফা-মারওয়া সাঈ করা। ছয়. মিকাতের বাইরের লোকদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ। এগুলো অনিচ্ছাকৃত ছুটে গেলে হজ আদায় হয়ে যাবে। তবে দম বা কোরবানি দ্বারা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।
প্রিয় পাঠক! হজ আদায়ের সুবিধার্থে হজের পাঁচ দিনের আমল ধারাবাহিকভাবে নিচে তুলে ধরা হল-
* প্রথম দিন ৮ই জিলহজ: হজের জন্য ইহরাম বেঁধে মিনার দিকে যাত্রা করবে। মিনায় পৌঁছে জোহর, আছর, মাগরিব ও এশার নামায নির্ধারিত সময় আদায় করা এবং রাতে মিনায় অবস্থান করবে।
* দ্বিতীয় দিন ৯ই জিলহজ: মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করে আরাফাতের দিকে রওয়ানা হবে। সেখানে পৌঁছে জোহর ও আসরের নামাজ নির্ধারিত সময় পড়ে নিবে। আর মসজিদে নামিরায় জামাতে শরিক হতে পারলে দুই নামাজ একসঙ্গে পড়তে হবে। অতঃপর আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবে এবং সেখানে ইস্তেগফার তিলাওয়াত যিকির ও দু’আ-দরূদ পড়ায় মগ্ন থাকবে। সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হবে। অতঃপর মুযদালিফায় পৌঁছে এশার নামাজের সময় মাগরিব ও এশা একসঙ্গে আদায় করবে। রাতে মুযদালিফায় অবস্থান করবে এবং এখান থেকে ৭০টি পাথর সংগ্রহ করবে।
* তৃতীয় দিন ১০ই জিলহজ: মুযদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে মিনার দিকে রওয়ানা হবে এবং সেখানে পৌঁছে দ্বি-প্রহরের পূর্বে শুধু মাত্র বড় জামারাতে (শয়তানকে) ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। অতঃপর ধারাবাহিকভাবে কোরবানি করবে, মাথা মুন্ডাবে, ইহরামের কাপড় খুলে সাধারণ কাপড় পরিধান করবে এবং সম্ভব হলে এ দিনই ‘তাওয়াফে জিয়ারত’ করে নিবে। আর যদি এ দিন তাওয়াফে জিয়ারত করা সম্ভব না হয়, তাহলে ১১ অথবা ১২ই জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বে অবশ্যই তাওয়াফে জিয়ারত করতে হবে। অবশেষে মিনায় রাতযাপন করবে।
* চতুর্থ দিন ১১ই জিলহজ: সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে যাওয়ার পর যথাক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় প্রত্যেক জামারাতে (শয়তানকে) ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবে।
* পঞ্চম দিন ১২ই জিলহজ: গতকালের মত আজও সূর্য হেলার পর যথাক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় জামারাতে (শয়তানকে) ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। অতঃপর ইচ্ছা করলে সূর্যস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করে মক্কা শরীফ চলে আসবে। মনে রাখতে হবে, এখনও যদি কোরবানি বা তাওয়াফে জিয়ারত বাকি থাকে তাহলে অবশ্যই ১২ই জিলহজ তা আদায় করতে হবে। (অবশেষে মক্কা শরীফ থেকে বিদায়ের পূর্বে ‘বিদায়ী তাওয়াফ’ করে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাবা ঘরের দিকে তাকিয়ে নিজ গন্তব্যে রওয়ানা হওয়া)।
প্রিয় পাঠক! প্রিয়নবীর প্রিয় শহর মদীনা মুনাওয়ারার জিয়ারত প্রত্যেক মুমিনের বাসনা। প্রকৃত মুমিনের হৃদয় সর্বদা মদীনার জিয়ারতে ব্যাকুল থাকে; যে পবিত্র ভূমি নবীকুল শিরমনি হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে বুকে ধারণ করে চিরধন্য; যার কোলে ঘুমিয়ে আছেন ইসলামের অতন্ত্র প্রহরী হাজারো সাহাবায়ে কেরাম। যে পবিত্র শহরে অবিরত ছড়ায় বেহেশতি সুবাশ, যেখানে প্রিয়নবীর পবিত্র রওজার সঙ্গে আছে একখন্ড জান্নাতি উদ্যান। যে বরকতময় নগরী সম্পর্কে প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি মক্কায় যেভাবে বরকত দান করেছেন, তার দ্বিগুণ বরকত মদীনায় দান করুন।’ (বুখারি: ১৭৬৪)।
প্রিয়নবী (সা.) আরো ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ মদীনাবাসীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র বা প্রতারণা করবে, সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে যেভাবে লবণ পানির মধ্যে মিশে নিশ্চিহ্ন যায়।’ (বুখারি: ১৭৫৬)। মহানবী (সা.) অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘আমার মিম্বার ও রওজার মাঝখানের অংশটুকু জান্নাতের বাগিচাসমূহের একটি বাগিচা।’ (বুখারী: ১১৯৫)। রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার পক্ষে সম্ভব হয়, সে যেন মদীনায় মৃত্যুবরণ করে। কেননা যে ব্যক্তি মদীনায় মৃত্যুবরণ করবে, কেয়ামতের দিন আমি তাঁর জন্য সুপারিশ করবো।’ (তিরমিজি: ৩৯১৭)।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদ তথা মসজিদে নববীতে লাগাতার চল্লিশ ওয়াক্ত নামায এমনভাবে আদায় করে যে, এর মধ্যে এক ওয়াক্ত নামাযও ছোটেনি, তাকে মুনাফেকি ও জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।’ (মুসনাদে আহ্মদ: ১২৫৮৩) ।
মদীনার নাম শোনামাত্রই হৃদয়ের আয়নায় ভেসে ওঠে সবুজ গম্বুজের ছবি; যার ছায়ায় শায়িত আছেন আমাদের প্রিয়নবী (সা.)। রওজায়ে রাসূল জিয়ারতের মাধ্যমে নবীপ্রেমিক উম্মতের তৃষ্ণার্ত আত্মা সতেজ হয়। জিয়ারতে মদীনা ব্যতীত শুধুমাত্র বাইতুল্লাহর জিয়ারতে মুমিন কখনো তৃপ্ত হতে পারে না।
হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে আমার ওফাতের পর আমার (রওজা) জিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।’ (সুনানে দারাকুতনি: ২৬৯৪)।
তাই প্রত্যেক বাইতুল্লাহর মুসাফিরের উচিত অত্যন্ত আদব, ভক্তি, বিনয় ও মহব্বত নিয়ে সোনার মদীনায় হাজির হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর রওজা শরীফও জিয়ারত করা এবং তাঁর শানে অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করা।
সম্মানিত পাঠক! প্রত্যেক খোদাপ্রেমিক মুমিন বান্দাই জিয়ারতে মক্কা ও জিয়ারতে মদীনার স্বপ্ন লালন করে, সর্বদা তৃষ্ণার্ত থাকে জিয়ারতের পিপাসায়। প্রকৃত প্রেমিক বান্দা কখনো বাইতুল্লাহ ও মদীনার জিয়ারতে তৃপ্ত হয় না। বরং প্রতিবার জিয়ারতে পিপাসা আরো প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ফিরে এসে প্রতিটি মুহূর্তে সে দগ্ধ হতে থাকে মক্কা ও মদীনার বিরহ বেদনায়।
তাই মহান প্রভুর দরবারে আমাদের এই মিনতি, হে আল্লাহ! আপনার সকল প্রেমিক বান্দাদের দয়ার চাদরে আবৃত করে হজ ও উমরার মাধ্যমে বার বার জিয়ারতে বাইতুল্লাহ ও জিয়ারতে মদীনার তাওফিক দান করুন। আমিন।