মহাস্থান নিউজ:
ছন-তালপাতা এখন আর ফেলনা নয়। নারীর নিপুণ হাতে ছোঁয়ায় ছন-তালপাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক রকমারি পণ্য । এসব পণ্য দেশের বাজার ছেড়ে যাচ্ছে বিশ্ববাজারে। যা থেকে আসছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। বলা যেতে পারে এ শিল্পে নারীদের ভাগ্যের সঙ্গে ঘুরছে দেশের অর্থনীতির চাকাও।
বগুড়া জেলা শহর বগুড়া থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শেরপুর উপজেলার শেরুয়া ও ধড়মোকাম থেকে শৌখিন এ হস্তশিল্প তৈরির কর্মযজ্ঞ এখন ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার গাড়ীদহ, শাহ বন্দেগী, কুসুম্বি, খানপুর, বিলাশপুরসহ ১০টি ইউনিয়নের আরও ৪০টি গ্রামে। ধীরে ধীরে ৮ থেকে ১০ হাজার নারী জড়িয়ে আছে হস্তশিল্প তৈরির এই কর্মযজ্ঞে।
গ্রামের লোকজন জানান, ঢাকা থেকে আসা একজন ব্যবসায়ী ১৯৮৫ সালে নারীদের হাতে তুলে দেন কাশফুলের খড়, ছন ও তালপাতা। সেখান থেকেই শুরু হয় ডালা-ঝুড়ির মতো শৌখিন হস্তশিল্প তৈরি। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম জুড়ে শুরু হয়ে যায় এ হস্তশিল্প। নারীদের তৈরি করা এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করেন ঢাকা থেকে আসা ঐ ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সাল থেকে ছন ও তালপাতার তৈরি ডালার প্রসার ঘটতে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে ক্লাসিকাল হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট প্রোডাক্ট বিডি লিমিটেড, আস্ক হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, ঢাকা হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, সান ট্রেড হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, কনেস্পো হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট নামে বেশ কয়েকটি বেসরকারি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এ শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন।
নারীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিটি গ্রামে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট রয়েছে। সেই সঙ্গে ১৫ থেকে ২০০ জন নিয়ে গঠিত হয় সমিতি। সমিতির নারী সদস্যরা তাদের দলপ্রধানের মাধ্যমে পণ্য দেন এজেন্টের কাছে। অনেক নারী এজেন্টদের কাছ থেকে হস্তশিল্প তালপাতা, ছন এবং পাটের সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ করেন। তা দিয়ে চাহিদামতো জিনিস তৈরি করে ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সরবরাহ করেন। অনেকে পণ্য বিক্রির পর কাঁচামালের অর্থ ফেরত দেন। আর এতে করে অতিরিক্ত মূলধনেরও প্রয়োজন হয় না এসব নারীদের। এর মাধ্যমে এসব নারী অর্থনৈতিকভাবেও সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তাদের হাতে তৈরি এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গাড়ীদহ ইউনিয়নের মহিপুর কলোনি এলাকার ভাই-বোন হ্যান্ডিক্র্যাফেটর স্বত্বাধিকারী মো. ইউনুস আলী বলেন, ক্লাসিকাল হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট প্রোডাক্ট বিডি লি. নামে বড় একটি প্রতিষ্ঠানে আমার পণ্যগুলো সরবরাহ হয়ে থাকে। ঐ প্রতিষ্ঠানসহ শেরপুরের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাহিদা মোতাবেক নানান ডিজাইনের ডালা অর্থাৎ ঝুড়ি তৈরির অর্ডার নেই। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্ধারিত ডিজাইন, তালপাতা ও ছন দিয়ে থাকি।
রাবেয়া খাতুন, শামসুন্নাহার, মৌমিতা রায় নামে কয়েক জন কারিগর জানান, পণ্য তৈরিতে প্রথমে তালগাছের পাতা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আঁশ বের করা হয়। এ আঁশ দেখতে ঠিক বেতের মতো। এছাড়া হোগলাপাতা ও কাশফুলের গাছ শুকিয়ে ঝুড়ি তৈরির কাঁচামাল প্রস্তুত করা হয়। পরে তালপাতার শুকনা আঁশ, হোগলাপাতা আর কাশফুলের উল বা প্লস্টিকের দড়ি দিয়ে হাতে বুনে ঝুড়ি তৈরি করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, হাতে তৈরি এসব ঝুড়ি স্থানীয়ভাবে তৈরি হলেও বিদেশে এ পণ্যের কদর অনেক বেশি। বাংলাদেশের মধ্যে বগুড়ার শেরপুরে এ ধরনের ঝুড়ি সবচেয়ে বেশি বানানো হয়। অন্য জেলাতেও কিছু তৈরি হয়। তবে বগুড়ার পণ্যের মান ভালো হওয়ায় চাহিদাও বেশি।
শেরপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. ওবাইদুল হক বলেন, এ উপজেলায় যারা নারী উদ্যোক্তা আছেন তাদের অনেককেই সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয়। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা উপজেলা পর্যায় থেকে করা হয়। সরকারিভাবে যে সব প্রকল্প দেওয়া হয়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তাদের মধ্যে তা বণ্টন করা হয়।