চীনে এমন ঘটনা বহু বছর ঘটেনি। ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো জনসংখ্যা কমেছে দেশটিতে। এই দেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৪১ কোটি ১৮ লাখ। গত বছরের তুলনায় সংখ্যাটা ৮ লাখ ৫০ হাজার কম। তবে অনেক আগে থেকেই চীনে জন্মহার কমছে। দিন কয়েক আগে দেশটির সরকারি পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন। অর্থনৈতিকভাবে এর বড় সুবিধা পায় তারা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, জনসংখ্যা কমতে থাকলে চীনের অর্থনীতি কি বিপদে পড়তে পারে? বিশ্লেষকদের অভিমত, এটা হয়তো স্বল্প মেয়াদে চীনের জন্য কোনো সমস্যা ডেকে আনবে না। তবে জনসংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকলে ২০৩০ সালের পর ধাক্কা খাবে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
বিপদটা আঁচ করতে পেরেই কি না, জনসংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে চীন সরকার। সাত বছর আগেই ‘এক সন্তান নীতি’ থেকে সরে এসেছে তারা। তবে জনসংখ্যাবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জটিল এ সমস্যার সহজ কোনো সমাধান আপাতত চীনের সামনে নেই। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে দেশটিতে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্যই বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তবে চীনের বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে। আর এটা এমন সময়ে ঘটছে, যখন মধ্য আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার পথে হাঁটছে বেইজিং। ফলে এককথায় এটা বলা যায় যে ধনী হওয়ার আগেই বুড়িয়ে যাচ্ছে চীন।
ধনী হওয়ার আগেই বুড়িয়ে যাচ্ছে চীন
যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্যই বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তবে চীনের বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে। আর এটা এমন সময়ে ঘটছে, যখন মধ্য আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার পথে হাঁটছে বেইজিং। ফলে এককথায় বলা যায়, ধনী হওয়ার আগেই বুড়িয়ে যাচ্ছে চীন।
চীনের এই বুড়িয়ে যাওয়ার শুরুটা জানতে একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। ২০১২ সাল থেকে দেশটির কর্মক্ষম অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা কমতির দিকে। একই সঙ্গে বেড়েছে নির্ভরশীল মানুষের অনুপাত। একটি দেশের কর্মক্ষম মানুষের ওপর শিশু ও বৃদ্ধদের নির্ভরশীলতার চিত্র এই অনুপাতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
চীনের সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, ২০১০ সালে চীনে নির্ভরশীল মানুষের হার ছিল ৩৭ দশমিক ১২। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৪৪ দশমিক ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর জাতিসংঘের তথ্য বলছে, চীনে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা চলতি শতকে ৬০ শতাংশের বেশি কমবে।
তবে কর্মক্ষম মানুষ কমে যাওয়াটা চীনকে শিগগিরই সংকটে ফেলবে না বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিবিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ফ্যাথম ফিন্যান্সিয়াল কনসালটিংয়ের উপপ্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু হ্যারিস। তাঁর মতে, চীনের গ্রামীণ এলাকায় সস্তা শ্রমের অভাব নেই। এসব শ্রমিক দিয়ে শহর এলাকার ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। আর দেশটির উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে শ্রম দেওয়ার মতো অনেক কর্মক্ষম মানুষ রয়েছেন। তাঁরা যত দিন বুড়িয়ে না যাচ্ছেন, তত দিন চীনের প্রবৃদ্ধির ওপর বড় ধরনের কোনো আঘাত আসবে না।
‘চীনের গ্রামগুলোতে সস্তা শ্রমের অভাব নেই। এসব শ্রমিক দিয়ে শহর এলাকার ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। দেশটির উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে শ্রম দেওয়ার মতো অনেক কর্মক্ষম মানুষ রয়েছেন। তাঁরা যত দিন বুড়িয়ে না যাচ্ছেন, তত দিন চীনের প্রবৃদ্ধির ওপর বড় কোনো আঘাত আসবে না’
অ্যান্ড্রু হ্যারিসের মতো একই কথা পল চেয়াংয়ের। সিঙ্গাপুরের সাবেক এই প্রধান পরিসংখ্যানবিদের ভাষ্যমতে, জনসংখ্যা কমতির সমস্যা সমাধানের জন্য চীনের হাতে এখনো যথেষ্ট মানুষ ও সময় রয়েছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে তারা বিপদে পড়ছে না। এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সিঙ্গাপুর ও জাপানের দিকে ইঙ্গিত করেন পল চেয়াং। দুটি দেশই নিজেদের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।
ধাক্কা আসতে পারে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে
চীনের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়তে পারে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও। কারণ, একটি দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে আসার অর্থ হলো শ্রমের দাম বেড়ে যাওয়া। এতে করে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। বেড়ে যায় ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য ও সেবার দাম।
দীর্ঘদিন ধরেই চীনকে ‘বিশ্বের কারখানা’ বলা হয়ে থাকে। শ্রম তুলনামূলক সস্তা হওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য উৎপাদনে চীনের শ্রমবাজার ব্যবহার করে আসছে। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চীনের শ্রমবাজার থেকে সরে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চীনের জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে এশিয়ার অন্যান্য দেশ ও লাতিন আমেরিকা।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিস—মেডেসনের গবেষক ই ফুজিয়ান। চীনের এক সন্তান নীতির সমালোচনায় দীর্ঘদিন মুখর ছিলেন তিনি। ফুজিয়ান বলেন, ‘চীনে দিন দিন ছোট হয়ে আসা শ্রমবাজার এবং উৎপাদন খাতে মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে দ্রব্যমূল্য বাড়বে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে।’
দীর্ঘদিন ধরেই চীনকে ‘বিশ্বের কারখানা’ বলা হয়ে থাকে।
শ্রম তুলনামূলক সস্তা হওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য উৎপাদনে চীনের শ্রমবাজার ব্যবহার করে আসছে।
তবে সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চীনের শ্রমবাজার থেকে সরে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
নজর দিতে হবে অন্য দিকেও
জন্মহার বৃদ্ধির নানা পদক্ষেপ নিলেও খুব কম সাফল্য পেয়েছে চীন। এ ক্ষেত্রে ভালো কিছু করতে হলে তাদের অন্য বিষয়ের দিকেও নজর দিতে হবে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক জর্জ ম্যাগনুস। তিনি বলেন, চীন অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। বর্তমানে চীনে বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে অবসরের বয়স ৬০ বছর।
চীনে কিন্তু এর আগে অবসরের বয়স বাড়ানোর প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। তবে সরকারের ওই প্রস্তাব মোটেও ভালোভাবে নেয়নি সে দেশের মানুষ। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বয়স্ক। তাঁদের ভাষ্য ছিল, এতে করে তাঁরা আরও দেরিতে পেনশনের অর্থ পাবেন।
এ ছাড়া কর্মক্ষম মানুষের ঘাটতি পূরণে চীন রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। তবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তির ব্যবহার আদৌ কোনো কাজে এসেছে কি না, তা পরিষ্কার নয় বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু হ্যারিস। তিনি বলেন, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে চীনের সামনে আরেকটি পথ খোলা আছে। সেটি হলো, বিদেশিদের অভিবাসনের সুবিধা দেওয়া। তবে ঐতিহাসিকভাবেই এই পদ্ধতির বিরোধী চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি।
শুধু চীনই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ধীরে ধীরে জনসংখ্যা কমবে বলে মনে করেন অধ্যাপক জর্জ ম্যাগনুস। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য বেশি জনসংখ্যা একটি দেশের লক্ষ্য হতে পারে না। বিষয়টি সব দেশের মাথায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দিলে, অন্য কোনো উপায়ে অর্থনীতিকে চাঙা রাখার দিকে নজর দিতে হবে তাদের।