আদমদিঘী প্রতিনিধিঃ চার দশক আগে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের শাঁওইল বাজারকে ঘিরে ঝুট কাপড় থেকে সুতা আর সেই সুতা দিয়ে সোয়েটার, মাফলার, চাদর, তোশকের কভার ইত্যাদি তৈরির ব্যবসা শুরু হয়েছিল। সীমিত আকারে শুরু হওয়া সেই ব্যবসা এত দিনে বগুড়াসহ চার জেলার শতাধিক গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।
তাঁতশিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও গাইবান্ধা জেলায় ১০ হাজারের বেশি হস্তচালিত তাঁতকল রয়েছে। আর বিদ্যুৎ-চালিত তাঁতকল আছে ১ হাজার ৫০০। এসব তাঁতকলকেন্দ্রিক ব্যবসা ও কার্যক্রমে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ৫০ হাজার নারীর। প্রতিদিন শাঁওইল বাজারে দোকান ও আড়ত মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠানে চলে জমজমাট বেচাকেনা। প্রতিবছর রংবেরঙের ৫০ রকম সুতা ও বিভিন্ন ধরনের তাঁতপণ্য মিলিয়ে শাঁওইল বাজারে মোট বেচাকেনা হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার।
যেখান থেকে শুরু
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে বর্ষীয়ান ব্যক্তি ও তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাঁওইল এলাকার মানুষ প্রায় শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় হস্তচালিত তাঁতে গামছা, শাড়ি ও লুঙ্গি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। বগুড়া সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ডিলারের মাধ্যমে সুতা আসত ভারতের কলকাতা থেকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত থেকে সুতা আসা বন্ধ হয়ে যায়। এতে সেখানকার তাঁতশিল্প সংকটে পড়ে। তা কেউ গ্রাম, আবার কেউবা পেশা ছেড়ে দেন। তেমনই একজন ছিলেন সোলায়মান আলী। ১৯৮২ সালে ফেরি করে গামছা বিক্রি করার সময় একদিন ঢাকার মিরপুর এলাকায় রাস্তার পাশে পোশাক কারখানার ফেলা বর্জ্য তথা ঝুট কাপড় তার চোখে পড়ে। তখন তিনি কয়েক বস্তা ঝুট কাপড় নিয়ে আদমদীঘির গ্রামের বাড়ি চলে আসেন।
সোলায়মান আলী বাড়িতে এসেই ঝুট কাপড় থেকে সুতা খুলে নেন। সেই সুতা দিয়ে হস্তচালিত তাঁতে তৈরি করা কিছু মাফলার বাজারে দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। এরপর তিনি ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ঝুট কাপড় এনে সুতা তুলে নানা রকমের তাঁতপণ্য পণ্য তৈরি করতে থাকেন। তা দেখে এলাকার আরও ৩০ থেকে ৩৫ জন তরুণ তাঁতি ঢাকা থেকে ঝুট কাপড় এনে সুতা খুলে তা দিয়ে তাঁতপণ্য তৈরির কর্মকাণ্ডে ঝুঁকে পড়েন। এ কর্মযজ্ঞ দ্রুতই বগুড়া জেলার আদমদীঘি, দুপচাঁচিয়া ও কাহালু; জয়পুরহাটের আক্কেলপুর ও ক্ষেতলাল এবং নওগাঁর সদর, রানীনগর, আত্রাই ও বদলগাছি এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শতাধিক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এসব গ্রামে উৎপাদিত সুতা কিনে নেন দেশের বিভিন্ন জেলার তাঁতিরা, যা দিয়ে তৈরি হয় উলের কম্বল, চাদর, মাফলার ও সোয়েটার, গামছা, মাঙ্কি টুপি, তোয়ালে, শাড়ি, লুঙ্গিসহ হরেক পণ্য। একসময় ঢাকায় ঝুট কাপড়ের কদর বেড়ে যায়। ফলে এটি কিনে আনতে হয় তাঁতিদের।
তাঁতের মালিক ও তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে শাঁওইল বাজার কেন্দ্র করে প্রতিবছর শীতকালে গড়ে ১০ লাখ কম্বল, এক কোটি চাদর, ৫০ লাখ গামছা ও তোয়ালে তৈরি হয়। পাইকারিতে প্রতিটি চাদর ১০০ থেকে ৬০০, কম্বল ১০০ থেকে ২৬০, গামছা ৫০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
বর্তমানে বগুড়ায় শাঁওইলের আশপাশের ধামাইল, ঘোড়াদহ, মঙ্গলপুর, অর্জনগাড়ি, সাঁকোয়া, চাঁদখইড়, কেশুরতা, মুরাদপুর, লক্ষ্মীকুল, ছাতিয়ান, ইশবপুর, মোহনপুর ও কুমারগাড়ি গ্রামে ঝুট সুতাসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় ও তাঁতপণ্য উৎপাদন হয়।
পোশাক কারখানার ফেলনা ঝুট কাপড় বাছাই করছেন নারী শ্রমিকেরা
ঝুট কাপড় থেকে যেভাবে সুতা তৈরি হয়
শাঁওইল এলাকার তাঁতিরা জানান, রাজধানী ঢাকাসহ গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলো থেকে কম দামে ঝুট কাপড় এনে প্রথমে রং অনুযায়ী আলাদা করা হয়। এরপর কাপড় থেকে হস্তচালিত যন্ত্রে সুতা কেটে ওয়েল্ডিং, ববিং করার পর রিং ও ডাইং বা রং করা হয়। তবে এ অঞ্চলে ডাইং মেশিন না থাকায় সুতা রং ও ডাইং করার জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে পাঠানো হয়। এভাবে প্রক্রিয়াজাত করে সুতা আবার শাঁওইল বাজারে আনা হয়। আড়ত থেকে এসব সুতা পাইকারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
শাঁওইলের সুতা আন্তর্জাতিক বাজারে
খুচরা ও পাইকারি বিক্রির জন্য শাঁওইল বাজার সব সময় জমজমাট থাকে। এ মোকাম থেকে সুতা যায় রাজধানী ঢাকা, নরসিংদীর বাবুরহাট, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, গাইবান্ধার কোচাশহর, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে ভারত, নেপাল ও ভুটানেও রপ্তানি হচ্ছে এখানকার সুতা। ঝুট কাপড় থেকে এখানে নানা রঙের প্রায় ৫০ ধরনের সুতা উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় অ্যাক্রেলিক সুতা। এটির কেজি ১৮০ থেকে ৪০০ টাকা। এ ছাড়া প্রতি কেজি স্মাইলিং বা টিটি সুতা ৩৫০ ও শ্যানেল সুতা ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
সুতা ও তাঁতপণ্যের বাজার
শাঁওইল বাজারের সুতা ব্যবসায়ী মো. মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে প্রতিদিন গড়ে ২০ ট্রাক ঝুট সুতা আসে। এক ট্রাক ঝুট সুতার গড় দাম ১০ লাখ টাকার মতো। সেই হিসাবে প্রতিদিন এ বাজারে গড়ে দুই কোটি টাকার ঝুট সুতার বেচাকেনা হয়। সে অনুযায়ী মাসে ৬০ কোটি আর বছরে ৭২০ কোটি টাকার ঝুট সুতা বিক্রি হয় বলে ধারণা করা যায়। এ ছাড়া বছরে ২০০ কোটি টাকার চাদর, কম্বলসহ অন্যান্য তাঁতপণ্য বিক্রি হয়।
সরেজমিনে একদিন
সম্প্রতি এক সকালে বগুড়ার আদমদীঘির শাঁওইল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে মোকামটি বেশ সরগরম, বেচাকেনাও বেশ জমজমাট। কোথাও কোথাও রং অনুযায়ী ঝুট কাপড় আলাদা করে রাখার কাজে ব্যস্ত নারীরা। আবার কেউ ওয়েল্ডিং, কেউবা ববিংয়ের কাজ করে চলেছেন।
আশপাশের কয়েকটি গ্রামে গিয়েও ঘরে ঘরে একই অবস্থা লক্ষ করা গেছে। সুতা তৈরি ছাড়াও বাড়িগুলোয় অনবরত হস্ত ও বিদ্যুচ্চালিত তাঁতকলের খটখট শব্দ শোনা যায়। কারণ, তাঁতকলগুলোয় নানা রঙের ও বাহারি নকশার চাদর ও কম্বল, গামছা, তোয়ালে, এসব পণ্য তৈরি হচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা এসব কাজ ভাগাভাগি করে নেন।
শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী। তাঁরা প্রতি কেজি সুতা কাটার কাজে মজুরি পান গড়ে ১৫ টাকা। এতে দিনে তাঁদের আয় হয় ১৩০ থেকে ২০০ টাকা। বানু বেগম (৫০) নামের একজন শ্রমিক জানান, তিনি এখন দিনে ১৭০ টাকা উপার্জন করেন।
ঝুট কাপড় থেকে সুতা তৈরি করছেন একজন নারী শ্রমিক
অনেকেই পারিবারিক পেশায়
পারিবারিক পেশার টানেই অনেকে এ ব্যবসায় এসেছেন বা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। শাঁওইল বাজারের সুতা ব্যবসায়ী জহরুল ইসলাম বলেন, তাঁতের কাপড় বোনা তাঁর চার পুরুষের পেশা। বাবা চুন্নু মিয়াও তাঁতে কম্বল বুনতেন। পৈতৃক পেশার টানেই তিনিও সুতার ব্যবসায় জড়িয়েছেন।
আরেক সুতা ব্যবসায়ী রুবেল শেখ জানান, তাঁর বাবা মোজাম্মেল শেখ তাঁতে কম্বল ও চাদর বুনতেন। নিজেও একসময় অন্যের তাঁতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ১০ বছর আগে ৮০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নিজেই সুতার ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি অনেকটা সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘৩৫ লাখ টাকায় ২৮ শতক জায়গা কিনেছি। দেড় কোটি টাকায় বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছি। ব্যবসায় আরও ৬০ লাখ টাকা পুঁজি খাটছে।’
ব্যবসায়ী শাহিনুর রহমান জানান, তাঁর বাবা আবদুল মান্নান ১৯৯৩ সালে পাবনার সুজানগর থেকে ব্যবসা করতে এসে এই এলাকাতেই থিতু হন। তিনিও শাঁওইল বাজারে সুতার ব্যবসা খুলে ভাগ্যবদল করেছেন। ১৯৯৮ সালে বাবার সঙ্গে দুই ভাই এখানে এসে ঝুটের ব্যবসা শুরু করেন। ২০১১ সাল থেকে আলাদা ব্যবসা করছেন। তিনি ইতিমধ্যে সাড়ে চার শতক জায়গা কিনে বাড়ি ও ছয় শতক জায়গা কিনে মার্কেট নির্মাণ করেছেন।
নারী শ্রমিক সাফিয়া বেগম বলেন, পোশাক কারখানার ঝুট সুতা আর তাঁত শুধু ব্যবসায়ী ও তাঁতিদের ভাগ্যই খুলে দেয়নি। হাজারো অসহায় নারী শ্রমিকেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। শ্রমিক থেকে অনেকেই ভাগ্য বদলে এখন ব্যবসায়ী হয়েছেন।
ক্রেতাদের কথা
গাইবান্ধার কোচাশহর থেকে শাঁওইল বাজারে সুতা কিনতে আসা ব্যবসায়ী আবদুল মতিন বলেন, এখানকার সুতার মান খুব ভালো। ঢাকা থেকে চাদর কিনতে আসা ব্যবসায়ী আজগর শেখ বলেন, ‘এখানকার কম্বল ও চাদরের মান খুব ভালো। দামও কম। সে কারণে বছরজুড়েই এখান থেকে কম্বল ও চাদর কিনে আড়তে মজুত করি।’
সমস্যা ও কিছু দাবি
শাঁওইল বাজারের সুতা ব্যবসায়ীদের সংগঠন তন্তুবায় সমবায় সমিতির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ঝুট থেকে তৈরি সুতা এবং তাঁতপণ্য মিলে এখানে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। তারপরও এ বাজারে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ শাখা নেই। এজেন্ট ব্যাংকিং চালু আছে। তা ছাড়া এখানে দোকান বসার জন্য কোনো শেড নেই। সে জন্য ঝড়-বৃষ্টি-রোদে খোলা আকাশের নিচে সুতা ও তাঁতপণ্যের পসরা সাজিয়ে বসতে হয় ব্যবসায়ীদের।
মোফাজ্জল হোসেন আরও বলেন, এখানকার সনাতনী তাঁতকলগুলো আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। এ জন্য সুতা প্রক্রিয়াকরণের ডাইং মেশিন স্থাপন, উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ এবং পণ্য বিপণনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা দরকার।
ঝুট কাপড় থেকে তৈরি সুতা বাঁধাই করছেন কয়েকজন শ্রমিক
উদ্যোক্তাদের পাশে এসএমই ফাউন্ডেশন
কয়েক বছর আগে এসএমই ফাউন্ডেশন শাঁওইল বাজারের তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করে। এরপর তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে অ্যাকাউন্টিং, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, ডিজাইন, ডাইং, আমদানি-রপ্তানি, বিপণন ও নেতৃত্ব প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে সাত কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। গত বছর এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান শাঁওইল তাঁতপল্লি পরিদর্শনে এসে তাঁতিদের সব রকমের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।