যমুনা নিউজ বিডিঃ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের আশপাশ থেকে রাশিয়া তার সৈন্যদের সরিয়ে নেবার পর থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলকেই তার অভিযানের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। পূর্ব ইউক্রেনের এই পুরোনো শিল্পকারখানা সমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে বলা হয় ডনবাস, যা ‘ডোনেট বেসিন’ বা ডোনেট নদীর অববাহিকার সংক্ষিপ্ত রূপ।
এখানে যুদ্ধের ফল কী হয় তার ওপরই নির্ভর করছে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের ভাগ্য। দৃশ্যত এ অভিযানে রাশিয়া অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য পায়নি। তাই প্রশ্ন হচ্ছে ইউক্রেনে, তার ভাষায়, ‘বিশেষ অপারেশনের’ সাফল্য দাবি করতে হলে তার কী কী অর্জন করতে হবে? রাশিয়া এখন দক্ষিণ ইউক্রেনের বিরাট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার দেশের প্রতি মিটার জায়গার জন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ডনবাস বলেন, তখন তিনি বোঝান ইউক্রেনের পুরোনো ইস্পাত ও কয়লা উৎপাদনকারী এলাকাটিকে, যার অর্থ সমগ্র দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলিয়ে একটি বড় অঞ্চল। প্রধানত রুশভাষী এই এলাকাটিকে ‘মুক্ত করার’ কথা বারবার বলে আসছেন পুতিন। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়াকে নিজের অংশ করে নেয়ার পর থেকে পুতিনের প্রক্সি বাহিনী এই ডনবাসের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এলাকা দখল করে নেয়।
যুদ্ধ শুরুর এক মাসের মধ্যেই রাশিয়া লুহানস্কের ৯৩ শতাংশ এবং দোনেৎস্কের ৫৪ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। তবে পুরো ডনবাসকে পদানত করা থেকে রুশ বাহিনী এখনো বহু দূরে। পুতিন কেন ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ চান
ইউক্রেনে অভিযান শুরুর ঠিক আগে পুতিন পুরো লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন, শুধু তার প্রক্সিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাটুকুকেই নয়। তিনি অভিযোগ করে আসছেন যে ইউক্রেন সেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে যার কোনো প্রমাণ রাশিয়া দেয়নি। ২০১৪ সাল থেকে এখানে সংঘাতে ১৪ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে।
পুতিন কী করতে যাচ্ছেন?
সম্ভবত রাশিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে ডনবাসকে রাশিয়ার অংশ করে নেয়া। ক্রাইমিয়াতে ২০১৪ সালের একটি বিতর্কিত গণভোট করার পরও তিনি ঠিক এটাই করেছিলেন। লুহানস্কে রাশিয়ার পুতুল সরকারের নেতা ইতোমধ্যেই বলেছেন অদূর ভবিষ্যতে সেখানে একটি গণভোট করা হবে।
কিছু খবরে বলা হয়েছে, লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলে এই গণভোট হয়তো এই মে মাসের মাঝামাঝিও হতে পারে।
তবে সমস্যা হচ্ছে, নতুন দখল করা এলাকাগুলো এখন ‘ওয়ার জোন’ যেখানে যুদ্ধ চলছে। তাই সেখানে ভোটাভুটি করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
পুতিনের রণকৌশল কী?
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী মনে করে, পুতিন শুধু যে ডনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চান তা নয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন, ক্রাইমিয়ার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল, এবং জাপোরিঝিয়ার কিছু অংশও নিয়ে নিতে চান তিনি। ফলে তিনি রাশিয়ার দক্ষিণ উপকুল বরাবর একটি ভূ-সংযোগ তৈরি করতে পারবেন। যাতে তিনি ক্রাইমিয়ার পানির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। খেরসনে রাশিয়া এর মধ্যেই তার নিজের মুদ্রা রুবল চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এখানেও হয়তো তিনি একটি প্রক্সি-প্রজাতন্ত্র সৃষ্টির জন্য একটি গণভোট করারও চেষ্টা করতে পারেননি। রুস্তর মিনেকায়েভ নামের একজন রুশ জেনারেল এমনটাও বলেছেন যে তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ওডেসা ছাড়িয়ে কৃষ্ণসাগর উপকুল পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। তবে এখন পর্যন্ত এটা শুধু উচ্চাভিলাষের বেশি কিছু বলে মনে হচ্ছে না। তবে দোনেৎস্কের অধিকাংশ এবং লুহানস্কের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো এখনো ইউক্রেনের হাতেই রয়েছে। এ কারণে রাশিয়া চাইছে ইউক্রেনের বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে। কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ট্রেসি জার্মান বলছেন, এটি একটি অনেক বড় এলাকা, এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক জটিলতাগুলো উপেক্ষা করার মত নয়। রুশ সীমান্তের দক্ষিণের খারকিভ শহরটি ইউক্রেনের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইজিয়াম শহরটি। এটি হচ্ছে একটি প্রধান মোটরওয়ে সংলগ্ন এলাকা যা দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চলে যাওয়া যায়। ‘আপনি যদি ইজিয়ামের আশপাশে রুশ বাহিনী কি করছে তার দিকে নজর দেন- তাহলে দেখবেন তারা প্রধান হাইওয়েগুলো ধরে ধরে এগুচ্ছে। এর কারণ হলো, তাদের যুদ্ধসরঞ্জামের বেশিরভাগই তারা নিয়ে যাচ্ছে সড়ক ও রেলপথ দিয়ে’ বলেন অধ্যাপক জার্মান। এখন যেসব শহরগুলোর দিকে রাশিয়া নজর দিচ্ছে এগুলোর বাসিন্দাদের ইতোমধ্যেই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।
তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে স্লোভিয়ানস্ক। এমওথ্রি রাস্তা দিয়ে এই শহরটিতে যেতে হয়, এবং এর লোকসংখ্যা ১২৫,০০০। ২০১৪ সালে এটি রুশ-সমর্থিত বাহিনী দখল করে নিলেও পরে তা আবার হাতছাড়া হয়। তাদের আরো একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে ক্রামাটরস্ক দখল করা।
রাশিয়ার লক্ষ্য কতটা সফল হবে?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দি স্টাডি অব ওয়ার বলছে, ইউক্রেন যদি স্লোভিয়ানস্ক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে তাহলে রাশিয়া লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক উভয় অঞ্চলই দখল করার যে চেষ্টা করছে তা ব্যর্থ হতে পারে। রাশিয়ার বাহিনী উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে চালানো তাদের অভিযানে লুহানস্কের অনেকগুলো শহরে আক্রমণ চালিয়েছে। তারা ক্রেমিনা দখল করেছে এবং রুবিঝননি, পোপাসানা এবং লিসিচানস্কের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এই শহরগুলো গুরুত্বপূর্ণ – কারণ এগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে তারা পশ্চিম দিকে এগিয়ে ইজিয়ামের ওপর আক্রমণ পরিচালনারত রুশ বাহিনীর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। রাশিয়ানদের দরকার সরবরাহ লাইনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, এবং পশ্চিম দিক থেকে ইউক্রেনীয়রা রেলপথে যে অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছে, সেই সংযোগটি আটকে দেয়া। কারণ, ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা হচ্ছে ট্রেন, যা দিয়ে তাদের সৈন্য ও ভারী অস্ত্রগুলো আসছে। এ ছাড়া পালায়নরত বেসামরিক লোকদের জন্যও এই রেলপথ জরুরি। এই রেলপথগুলো দখলে নিতে পারে রাশিয়া আবার তাদের সৈন্য ও রসদপত্র-সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য এগুলোকে ব্যবহার করতে পারবে। তাছাড়া ইউক্রেনের রেল নেটওয়ার্ক লক্ষ্য করে রাশিয়া অতিসম্প্রতি বেশ ক’টি ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে পশ্চিমা দেশগুলো যে অস্ত্র পাঠাচ্ছে তা সরবরাহের জন্য এই রেল ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রুশ বাহিনী এর আগেও ইউক্রেনের রেল ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ইউক্রেনের স্থানীয় সামরিক প্রশাসনের প্রধান সেরহিই হাইদাই মনে করেন, রুশদের লক্ষ্য হচ্ছে লুহানস্কের পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত পর্যন্ত পৌছানোর পথে সবরকম বাধা নিশ্চিহ্ন করা। ভ্লাদিমির পুতিন ঠিক এটাই চান।
ইউক্রেনের বাহিনী কি নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে?
যুদ্ধের শুরুতে মনে করা হতো যে ইউক্রেনের যৌথ বাহিনী বা জেএফও যে ১০টি ব্রিগেড নিয়ে গঠিত- সেগুলোর হাতে তাদের সবচেয়ে সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য এবং সেরা অস্ত্র ও সরঞ্জামগুলো আছে। তবে রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের স্যাম ক্র্যানি-ইভান্স বলছেন, এখন ইউক্রেনীয় বাহিনীর শক্তি কতটা আছে তা তাদের অজানা। তবে স্বেচ্ছাসেবকরা যোগ দেবার ফলে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে থাকতে পারে। ‘ইউক্রেনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রুশ পক্ষে যত বেশি সম্ভব বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো। এ জন্য ইউক্রেনীয় বড় আকারের খন্ডযুদ্ধ এড়িয়ে বিচ্ছিন্নভাবে নানা জায়গায় আক্রমণ চালাচ্ছে’ বলেন কনরাড মুজিকা, রোচান কনসার্ল্টিং নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনের পূবাঞ্চলে রাশিয়ার এখন ৯৩টি ব্যাটালিয়ন ট্যাকটিকাল গ্রুপ কাজ করছে। এতে সাধারণত ৭০০ থেকে ৯০০ সৈন্য থাকে, কিন্তু যুক্তরাজ্য বলছে, রুশদের অধিক সৈন্যসংখ্যা তাদেরকে এমন কোন সুবিধা দিতে পারেনি, যা যুদ্ধের ফল বদলে দিতে পারে। রাশিয়া এখন সৈন্য সংখ্যা বাড়াচ্ছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বড় কোন বিজয় এনে দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দুই মাসেরও বেশি সময়ের এ যুদ্ধে রাশিয়ার ইতোমধ্যেই বড় সংখ্যায় সৈন্য নিহত হয়েছে। তাদের মনোবলও কমে গেছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের ইউনিটগুলো গঠিত স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো থেকে নেয়া লোকদের দিয়ে। এদের অনেকেই বৃহত্তর রুশ বাহিনীর সেনাদের সহ-মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হয়। এখন বলা হচ্ছে, আগামী ৯ মে ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন এবং তার ফলে হয়তো রুশ বাহিনীতে আরও সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হবে।
খবর বিবিসি বাংলা