আবুহুমাইর হোছেন বাপ্পি,কক্সবাজার প্রতিনিধিঃ কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের চিংড়ি জোন খ্যাত ফুলছড়ি মৌজায় প্রতি বছর হাজারো একর জমিতে সাদা সোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ি ও লবণ চাষ হয়। এতে শতকোটি টাকা আয় হলেও চাষিদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি সময়ে একের এক এসব চিংড়ি ঘেরের লবণ মাঠে চলছে ডাকাতির ঘটনা।
গত শুক্রবার ভোর রাতে উপজেলার খুটাখালী-ফুলছড়ি মৌজার ৩ টি চিংড়ি ঘের ও লবণ বোটে গণডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এতে পাম্প মেশিন, ছাগল, জাল ও মোবাইলসহ প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১০ জন। তারা হলেন- ফুলছড়ি মৌজার উত্তর হইয়াখালী আকতার আহমদ মেম্বারের চিংড়ি ঘোনার বশির আহমদ(৫৫), দক্ষিণ হইয়াখালীর জাফর আহমদের চিংড়ি ঘোনার কামাল হোসেন(২৫), সাগর(২০), মনছুর আলম (২৯), নাছির উদ্দীন (৩০), রমজান আলী (৩২), হাফেজী ঘোনার ছুরত আলম (৬০) ও লবণ বোটের ৩ জন কর্মচারী। তাদের নাম জানা যায়নি। আহতদেরকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছেন।
উত্তর হইয়াখালী চিংড়ি ঘেরের মালিক সাবেক মেম্বার আকতার আহমদ জানান, প্রতিদিনের ন্যায় আমার কর্মচারী বশির ঘেরে পাহারা দিচ্ছিলেন। রাত যখন গভীর হয় তখন ২০/২৫ জনের অস্ত্রধারী ডাকাতদল ঘেরের বাসায় হানা দিয়ে ১৪ টি ছাগল, ১২ টি লবণ মাঠের পাম্প মেশিন, টর্চ লাইট, নগদ টাকা ও মোবাইল লুট করে তার প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে বলে তিনি দাবী করেন।
একই রাতে দক্ষিণ হইয়াখালী জাফর আহমদ,হাফেজী ঘোনা ও কাটাখালী খালের মুখে লবণ বোটে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসময় ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে লবণ চাষী ও বোট কর্মচারীদের জিম্মি করে জাফর আহমদের ঘোনা থেকে ২টি পাম্প মেশিন, নগদ টাকা, মোবাইল ও মালামাল লুট করে হাফেজি ঘোনা থেকেও ছাগলসহ মালামাল লুটপাট করা হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এসব মালামাল লুট করে ইন্জিন নৌকা নিয়ে চলে যাওয়ার পথে ২জন কর্মচারীকে সাথে নিয়ে মাঝপথে ছেড়ে দেয় বলে জানা গেছে।
স্থানীয় লবণ চাষিদের অভিযোগ, এলাকার চিহ্নিত ডাকাত দলের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে চিংড়ি ঘের মালিক ও চাষি। প্রতিনিয়ত ডাকাত দলের তান্ডব ও নির্যাতনে চিংড়ি ঘেরের লবণ মাঠে বিনিয়োগকৃত পুঁজি আহরণ করতে না পেরে বেশির ভাগ চাষি লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
তারা জানান, উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের ফুলছড়ি মৌজায় প্রায় হাজার একর চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ রয়েছে। এসব ঘেরে ইজারাদার, মালিক- চাষী মিলে প্রায় হাজার শ্রমিক কর্মচারী চিংড়ি ও লবণ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
সূত্রমতে, লবণ উৎপাদন শুরু হতে না হতেই ঘের এলাকায় ডাকাতরা হানা দেয়। বর্ষা মৌসুমে দলের সর্দারদের হাতে তাদের চাহিদা মতো মাসোহারা পরিশোধ করতে হয়। চাঁদা না দিলে রাতের আঁধারে সশস্ত্র ডাকাতদলের সদস্যরা ঘেরের মালিক ও কর্মচারীদের নির্মমভাবে পিঠিয়ে নৌকা, মাছ, জালসহ বাসার মালামাল এমনকি চাল, ডাল পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে বাধা দিলেই প্রাণহানিসহ ভয়াবহ নির্যাতন জোটে কপালে।
প্রাণের ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অসংখ্য লবণ চাষি দাবি করেছেন, সন্ধ্যার পরপরই পুরো ফুলছড়ি এলাকা চলে যায় ডাকাত দলের নিয়ন্ত্রণে। যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ অজুহাত দেখিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। শুনেও না শুনার মতো করে থাকে। ফলে বেশির ভাগ চাষি লাভের আশায় লবণ চাষ করলেও বছর শেষে পুঁজি হারিয়ে শূন্য হাতে ঘরে ফিরছে।
খুটাখালী এলাকার বেশির ভাগ লবণ- চিংড়ি চাষি দাবি করেছেন, র্যাবের অভিযানের পর বেশ কিছুদিন ডাকাতরা ভয়ে শঙ্কিত থাকলেও প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে পেশাদার ডাকাতরা।
লবণ চাষিদের মতে, খুটাখালী-ডুলাহাজারা কাটাখালী, সওদাগরঘোনা-চরণদ্বীপ এলাকার ডাকাতরা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পুরো চিংড়ি ঘের এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব ডাকাতদল চিংড়ি ঘেরে ডাকাতির পাশাপাশি ঘের এলাকায় লালন-পালন করা ছাগলগুলো লুটপাট করে নৌপথে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। খুটাখালী এলাকার এসব চিংড়ি ঘেরে ডাকাতি ও লুটপাট ডাকাত দলের নিত্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাকাতের ভয়ে ঘের মালিক ও চাষিরা মুখ খুলছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক লবণ চাষি বলেন, প্রতিনিয়ত খুটাখালীসহ উপকুলীয় এলাকায় চিংড়ি জোনে ডাকাতি ও লুটপাট চালিয়ে আসছে ডাকাতরা। প্রতিবাদ করলে মারধর ও হামলা করছে ডাকাতদল। তাদের অত্যাচারে অসহায় হয়ে পড়েছেন ওই এলাকার লবণ চাষি। এসব চিহ্নিত ডাকাতদের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে। একাধিক মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়াতে ডাকাতরা নিরাপদ আস্তানা হিসেবে চিংড়ি ঘের বেছে নিয়েছে।
খুটাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ মুহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ডাকাতরা চিংড়ি জোনের লবণ মাঠে ডাকাতি ও লুটপাট করছে মেশিন, ছাগলসহ বিভিন্ন মালামাল। এসব ডাকাত বাহিনীর ব্যাপারে একাধিকবার র্যাব-পুলিশ বাহিনীকে বলা হয়েছে এবং উপজেলা পরিষদে আইন-শৃঙ্খলা বৈঠকে তাদের গ্রেফতারের জন্য বলা হয়েছে। এসব বাহিনীর অত্যাচারে ঘের মালিকরা লবণ ও মৎস্য চাষ করতে পারছেন না।
চকরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ ওসমান গনি বলেন, আমি শুনেছি ওইসব এলাকায় ডাকাতরা চিংড়ি ঘেরে তান্ডব ও লুটপাট চালায়। এসব ডাকাতদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারে দ্রুত অভিযান চালানো হবে। এমনকি চিংড়ি ঘের মালিক ও লবণ চাষিরা যাতে নির্ভয়ে চাষ করতে পারেন সেজন্য পুলিশি অভিযান অব্যাহত রাখা হবে।