উজানে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, দখল-দূষণ এবং গতিপথে মানুষের অবৈধ হস্তক্ষেপে বিপন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী করতোয়াও এখন মৃতপ্রায়।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রধান তিনটি নদী পদ্মা মেঘনা যমুনা ছাড়াও সরকারি তথ্য মতে ছোট বড় মিলে ৪০৫টি নদীর হিসেব পাওয়া যায়। করতোয়া নদীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বগুড়া অংশে। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা এককালের প্রমত্তা করতোয়া এখন মৃত নদী। উজান থেকে পানির প্রবাহ নেই। তাই দখল আর আবর্জনার দূষণে এ নদী জর্জরিত।
অব্যাহত দখল, শহরের বাসা-বাড়ির বর্জ্য, খনন বা সংস্কার না হওয়া ও দূষণে পচা নর্দমার ড্রেন বা ক্যানেলে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে দিনে শুকর-কুকুরদের অবাধ বিচরণ। শহর এলাকার মধ্যে দত্তবাড়ি ঘাট, কাজীখানা ঘাট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় করতোয়া নদীর তীরবর্তী ২৮টি স্পট দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ চললেও কেউ দখলবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ অহরহ। একদিকে দীর্ঘদিন খনন না হওয়া ও অন্যদিকে দখল চলতে থাকায় বগুড়ার মানচিত্র থেকে প্রমত্তা ‘করতোয়া নদী’ হারিয়ে যেতে বসেছে।
সনাতন ধর্মগ্রন্থে একটি পবিত্র নদী হিসেবে করতোয়ার কথা এর উল্লেখ আছে। নদীটি বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় দিয়ে প্রবাহমান। মহাভারতে বলা আছে, তিন দিন উপবাসের পর করতোয়া নদীতে ভ্রমণ করলে এক অশ্বমেধার সমান পুণ্যলাভ হয়। আরেকটি প্রাচীন শহর শ্রাবন্তী, সেটি মহাস্থানগড়ের উত্তরে করতোয়ার পাড়ে অবস্থিত ছিল বলে মহাভারতে উল্লেখ আছে। ‘কর’ অর্থ হাত, আর তোয়া অর্থ ধোঁয়া জল, অর্থ্যাৎ হাত ধোয়া জল, হিন্দু ধর্মীয় দেবতা হিমালয়ে ধ্যানমগ্ন শিব পার্বতীকে বিয়ে করার সময় শিবের হাত ধোঁয়া জল থেকেই করতোয়া নদীর উৎপত্তি।
তাছাড়া বিশিষ্ঠ ইতিহাসবিদ প্রভাত চন্দ্র সেন ‘বগুড়ার ইতিহাস’ গ্রন্থেও ভারতের হিমালয় পাদদেশ থেকে করতোয়া নদীর উৎপত্তির উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে এই নদী চারটি আলাদা ভাগে বিভক্ত। উত্তরের অংশ দিনাজপুর-করতোয়া হচ্ছে আত্রাই নদীর প্রধান উৎস। রংপুর-করতোয়ার উপরের অংশ জলপাইগুড়ি জেলা থেকে উৎপন্ন। এটি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত দিওনাই-যমুনেশ্বরী নামে পরিচিত। তৃতীয় শাখা যমুনেশ্বরী-করতোয়া গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় এবং প্রধান গতিপথটি কাটাখালি হয়ে বাঙ্গালি নদীতে গিয়ে পড়ে। এটিই বগুড়ার করতোয়া, যেটি হুরাসাগরে গিয়ে পড়েছে।
মোট ৫৯৭ কিলোমিটার বা ৩৭৩ মাইল দৈর্ঘ্যের করতোয়া নদীতে আশির দশকে প্রচুর পানি থাকায় প্রমত্তা ছিল। “জনশ্রæতি আছে করতোয়া নদীতে সওদাগরী জাহাজ, লঞ্চ এবং বড় বড় নৌকা (বজরা) যেটা বলে সেটা যাতায়াত করতো। পণ্য পরিবহন হতো এবং ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পুর্ন্ড্রবর্ধন নগরী বগুড়া এবং করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠেছে।
বগুড়া শহরের শাহ্ ফতেহ আলীর (রহ.) মাজার সংলগ্ন এ নদীতে ঘাট ছিল। পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি থেকে বগুড়া পর্যন্ত প্রায় ৬০কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীর দুই তীরে সেচ দেওয়া যেত। তীরে বসবাসকারীরা খাবার পানি সংগ্রহ ও প্রাত্যহিক কাজ করতেন এ নদীর পানি দিয়ে। খর¯্রােতা হওয়ায় পারাপার খুবই কষ্টসাধ্য ছিল।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্র্ড ১৯৮৮ সালে উজানে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার খুলশিতে বাধ ও সুইসগেইট নির্মাণ করে। সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতার কারনে করতোয়ার পানি প্রবাহের গতিপথ সম্পূর্ণ বন্ধ ও ভরাট হয়ে গেছে। সে থেকেই প্রভাবশালীরা ধীরে ধীরে দখল-দূষণ নানা প্রাকৃতিক কারনে বন্যাজনিত ক্ষয়-ক্ষতি ও নদী সংস্কারের অভাবে করতোয়া পূর্বের সকল বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানুষের অপরিনামদর্শী কর্মকান্ড প্রভাব ফেলেছে করতোয়া নদীর উপর।
বর্তমানে বগুড়া পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ডের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের আবর্জনা, ড্রেনের পানি নদীর বুকে এসে পড়ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় ১৫-১৬ টন বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে আর নদীর পানি পচে কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে গেছে। অপর্যাপ্ত পানি প্রবাহ ও দখলবাজদের অবৈধ দখলের কারণে ¯্রােতস্বীনি বেগমতি করতোয়া নদী এখন মৃতপ্রায়। সচল, সজিব, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতিক করতোয়া নদী এখন হয়ে উঠেছে শ্রীহীন, কঙ্কালসার, নিশ্চুপ ও স্থবির। স্বচ্ছ জলপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কারনে নদীতে দ্রুতহারে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।
এদিকে বগুড়ার স্থানীয় জনগণ করতোয়া নদী দখলের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতাকে দায়ী করে অবিলম্বে প্রভাবশালীদের কবল থেকে নদীরক্ষা ও খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখা নদীরক্ষায় গণস্বাক্ষর কর্মসূচিও শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, বগুড়াকে বাঁচাতে হলে ব্যাপক পরিবেশগত সচেতনতা ও স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে করতোয়া নদী সচল রাখতে হবে।
এ বিষয়ে বগুড়ার বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম বাদশা জানান, পৌরসভা অনেক আগেই চিঠি দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কাউন্সিলরদের নিয়ে কমিটি করে ময়লা যাতে করতোয়ায় না পড়ে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
বগুড়া সদর আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু এ প্রতিবেদককে জানান, পুর্ন্ড্রবর্ধন নগরী ছেদিত করতোয়া নদীই বগুড়ার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। এ নদীকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নদী ও খাল-বিলের পানি প্রবাহে বাধা সৃৃষ্টিকারী সব ধরনের স্থাপনা অবিলম্বে ভেঙে ফেলার নির্দেশনাসহ ডিসিকে জরুরি ভিত্তিতে এবিষয়ে লিখিত নির্দেশনা পাঠাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক নদীর অবৈধ জায়গা উদ্ধারে বগুড়ার করতোয়া নদীর নাম রয়েছে এই সরকারি তালিকায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় সান্যাল জানান, নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং পানির প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখতে ২০১৫ সালের ২২ জুন জেলা প্রশাসকসহ ২১ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করে বেলা নামের সংগঠন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশে জেলা প্রশাসন করতোয়া নদীর সীমানা দখল করে নির্মিত কিছু স্থাপনা অপসারণ করে।
বগুড়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, শহরের মধ্যে করতোয়া নদীর কয়েকটি স্থানে দখল হয়েছে। নদী দখল হয়ে যাওয়া স্থানে বাড়িঘর, ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। একাধিকবার করতোয়া নদী দখলের সঙ্গে জড়িত থাকা ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ৩৫ জন দখলদারের মধ্যে ২৮ জনকে মুক্ত করা হয়েছে। বাকিগুলো মামলা রয়েছে। একই সঙ্গে নতুন করে দখলদারের তালিকা তৈরি হচ্ছে। নতুন দখলদারের বিরুদ্ধেও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হক জানান, করতোয়া নদী রক্ষায় বেশকিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। ২০১১ সালে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করা হয়। সে সময় থেকে ‘করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রস্তাব করা হয়। সম্প্রতি করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্পটি আবারো সমীক্ষার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেল (আইডবিউএম), বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিবিএস) ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন যৌথভাবে এই সমীক্ষা করছে। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সমীক্ষা শেষ হওয়ার কথা। করতোয়া নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলছে। তবে ২০১৯ সালের পর এটি বেশি জোরদার হয়। এ প্রকল্পটির সমীক্ষা করছে তিন প্রতিষ্ঠান। প্রথম ধাপ এ মাসেই শেষ হবে। সমীক্ষায় কমপোনেন্টগুলো (উপাদান) যাচাই শেষ হলে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হবে।
তাছাড়া বর্তমানে এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে করতোয়া নদীর পরিবেশ দূষণ বন্ধ, শহরের যানজট নিরসনে সড়ক নির্মাণ। করতোয়া নদীর বগুড়া জেলা অংশের শিবগঞ্জ উপজেলার উত্তরের সীমানা থেকে শেরপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত মোট ১২৩ কিলোমিটার এলাকা খনন। একই সঙ্গে খনন করা হবে সুবিল খাল ৩১ কিলোমিটার, ইছামতী নদী ৭২ কি.মি ও গজারিয়া খালের ৩৫ কিলোমিটার। নদীর দুই পাড়ের ২৭ কিলোমিটার এলাকায় ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা ও ৬ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ, মাস্টার ড্রেন নির্মাণকাজ, পানি নিয়ন্ত্রণে তিনটি অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর দুই পাড়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ, পানির ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণকাজ। প্রকল্পের অধীনে ভূমি অধিগ্রহণ থাকবে। এ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এখানে সুখবর হচ্ছে প্রস্তাবনাটি একনেকের সবুজ পাতাভুক্ত হয়ে আছে।
সম্প্রতি বগুড়া সার্কিট হাউজে স্মার্ট বগুড়া’ বিনির্মাণে জেলা প্র্রশাসন ওই পরামর্শমূলক কর্মশালায় জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, করতোয়া নদী বগুড়ার প্রাণ। কিন্তু দখল-দূষণে করতোয়া নদীর প্রাণবৈচিত্র্য প্রায় নিঃশেষ। শহরের অংশে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার নদী প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীকেন্দ্রিক শহর ছিল একসময় বগুড়া। সভ্যতার বিবর্তনে করতোয়া এখন ধুঁকছে। স্মার্ট বগুড়া গড়ার অংশ হিসেবেই ‘স্মার্ট করতোয়া রিভার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে করতোয়া তার যেমন হারানো যৌবন ফিরে পাবে, তেমনি স্মার্ট বগুড়া গড়াও সহজ হবে।