নাম ফাতেমা বেগম। পিতা শাহেদ মিয়া। থাকেন কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ওই নারী বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও জালিয়াতির মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের ঠিকানা ব্যবহার করে বানিয়েছেন জন্মনিবন্ধন সনদ। আর সেই সনদ ব্যবহার করে তৈরি করেছেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট। বিষয়টি ধরা পড়ার পর পাসপোর্ট বাতিল করতে স্থানীয় পুলিশ সুপারকে (ডিএসবি) চিঠি দেওয়া হয় স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে। এখানেই শেষ নয়, এরপর এই নারী পাসপোর্ট সম্পাদনা করে ফের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নেন গাজীপুরের শ্রীপুর থানা থেকে। ফলে দুই দুইবার পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের পেশাদারিত্ব নিয়েও। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করলেও দায় নিতে রাজি নয় প্রশাসন।
জানা যায়, ফাতেমা বেগম গত বছরের ১১ জুলাই কিশোরগঞ্জের গুরই ইউনিয়ন পরিষদের ঠিকানা ব্যবহার করে প্রথমে নিজের জন্মনিবন্ধন নম্বর তৈরি করেন। যার নম্বর: ২০০৫৪৮১৭৬৩৮১১৫০৭৩। জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী তার জন্ম ২০ আগস্ট ২০০৫। এরপর এই জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করেই কিশোরগঞ্জ থেকে তৈরি করেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট। যার নম্বর: এ১১৩২১৩৬৬। তিনি এই পাসপোর্ট হাতে পান গত বছরের ১৮ জুলাই। এরপর বিষয়টি ধরা পড়লে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের ডিএসবি প্রধানকে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে পাসপোর্ট বাতিল করতে চিঠি দেওয়া হয় পুলিশ (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) সদর দপ্তর থেকে। একই সঙ্গে ফাতেমা বেগমের পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ ডিএসবির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা করা হয়। প্রথমে এসআই আসাদুজ্জামানের দায়িত্ব অবহেলায় পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে উল্লেখ করে তাকে কেন চাকরিচ্যুত করা হবে না, সেটি জানতে চেয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির জবাবে আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘ফাতেমার পক্ষে দুজন ব্যক্তি তার কাছে গিয়ে ফাতেমার কাগজপত্র জমা দেন। এ সময় তারা জানান ফাতেমার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে জরুরি ভিত্তিতে দেশের বাইরে নেওয়া প্রয়োজন।’ অসুস্থতার কথা ভেবে তিনি আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন বলে চিঠিতে জানান আসাদুজ্জামান। তবে ওই দুই ব্যক্তির কোনো পরিচয় বা ফোন নম্বর এই পুলিশ কর্মকর্তা দেখাতে পারেননি। তার বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। মামলার অভিযোগে রোহিঙ্গা নারীর পাসপোর্ট পাওয়ায় পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব অবহেলা ও উদাসীনতাকে দায়ী করা হয়।
এখানেই শেষ না। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো এরপর ওই নারী নিজের পাসপোর্ট সম্পাদনা করে কিশোরগঞ্জের গাজীপুর আর গুরই ইউনিয়ন পরিষদের বদলে সেখানে দিয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার লোহাগাছ ইউনিয়ন পরিষদের নাম। এরপর তিনি সম্পাদনা করা ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে গত বছরের ১৯ নভেম্বর শ্রীপুর থানায় পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করেন। আবেদনের মাত্র ৫ দিনের মধ্যে গত বছরের ২৫ নভেম্বর তিনি পুলিশ ক্লিয়ারেন্সও পেয়ে যান। এই রোহিঙ্গা নারীর পাসপোর্ট, জন্ম সনদ ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের কপি রয়েছে কালবেলার হাতে।
একজন রোহিঙ্গা নারীকে ভুয়া পাসপোর্টে যাচাই-বাছাই না করে কীভাবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হলো জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজামান কালবেলাকে বলেন, ওই ক্লিয়ারেন্স তিনি দেননি। তিনি ওখানে নতুন যোগদান করেছেন। এই বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। বিষয়টি নিয়ে পরিদর্শক (তদন্ত) শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। এরপর শাখাওয়াত হোসেনকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘ওই ক্লিয়ারেন্স ওসি সাহেব দিয়েছেন। ওই ক্লিয়ারেন্সের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ আপনি থানার তদন্ত কর্মকর্তা, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শাখাওয়াত বলেন, ‘ক্লিয়ারেন্সের বিষয়টি ওসি স্যার নিজে দেখেন।’
পুলিশ ক্লিয়ারেন্সে গাজীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. রবিউল ইসলামের স্বাক্ষর দেখা যায়। পরে তাকে ফোন দেওয়া হলে তিনি জানান, তার কাজ স্বাক্ষর করা। বিষয়টি তদন্ত করে থানা। এই বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। থানায় যোগাযোগ করতে বলেন।
এর কয়েক ঘণ্টা পর গাজীপুর পুলিশের পরিদর্শক (ডিএসবি) মনিরুজ্জামান পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদককে একজন ফোন দিয়ে বলেন, ‘আপনি অ্যাডিশনাল এসপি স্যারকে ফোন দিয়েছেন কেন?’ এরপর ওই ক্লিয়ারেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি ধরবেন গাছের গোড়ায়। ক্লিয়ারেন্স তো তেমন কিছু না। ওই নারী তো কিশোরগঞ্জ থেকে পাসপোর্ট বানিয়েছে। আপনি ধরবেন পাসপোর্ট কীভাবে করল সেটা।’ এরপর তিনি বলেন, ‘এক কনস্টেবল এটা করেছিল। এখানে কিছু ভুল হতে পারে। ওই কনস্টেবল এখন এখানে নেই, বদলি হয়ে গেছে। আপনারা গাছের গোড়ায় ধরেন, পাসপোর্ট কীভাবে করল সেটা ধরেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাবেক শ্রীপুর থানা এবং বর্তমান গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার ওসি এ এফ এম নাসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে তাকে (ফাতেমা) পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিলাম। পরে যখন জানতে পারি তার নাম-ঠিকানা সব ভুয়া, পরে আবার তা বাতিল করে দিই।’ ওসি বাতিল করে দিয়েছেন দাবি করলেও একটি সূত্রে জানা গেছে, ওই পুলিশ ক্লিয়ারেন্সটি এখনো বহাল রয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অভিযুক্ত রোহিঙ্গা নারী ফাতেমা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। দুদিন ধরে তার পাসপোর্টে দেওয়া ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।