পেয়ে হারানোর বেদনায় পুড়ছেন নৌকার ৩৬ মাঝি!
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন নাসিরুল ইসলাম খান। হলফনামায় মামলার তথ্য গোপন করায় জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। এরপরে নির্বাচন কমিশনে আপিল করে তিনি মনোনয়ন ফিরে পান। মনোনয়নপত্র ফিরে পেতে তাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।
এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। চুন্নুকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তার জামানত বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন নাসিরুল ইসলাম খান। কিন্তু জোটের কারণে ভোটের লড়াইয়ে নামার আগেই থামতে হলো নাসিরুল ইসলাম খানকে। মুজিবুল হক চুন্নুকে আসনটি ছেড়ে দিয়ে তার মনোনয়নপত্র তুলে নেওয়া হয়েছে।
বগুড়া-৪ (নন্দীগ্রাম-কাহালু) আসনে দীর্ঘ ২২ বছর পর দেওয়া হয়েছিল নৌকার প্রার্থী। প্রার্থী ছিলেন কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন কবিরাজ। কিন্তু আবারও ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদকে আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় আশাহত হয়েছেন তিনি। নৌকা হারিয়ে আওয়ামী লীগের এ প্রার্থী ‘মনে হয় কোনো জন্মে পাপ করেছি’ লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী জানান, বগুড়া-৪ আসনটি দীর্ঘদিন জামায়াত ও বিএনপির দখলে ছিল। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নন্দীগ্রামের শহীদুল আলম দুদুকে নৌকার মাঝি করা হয়েছিল। ১৪ দলীয় জোট গঠনের পর থেকে এ আসনের জনগণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। আসনটি জেলা জাসদ সভাপতি একেএম রেজাউল করিম তানসেনকে ছেড়ে দেওয়ায় শোকাহত তারা।
নাসিরুল ও হেলাল উদ্দিন কবিরাজের মতো নৌকা পেয়েও ভোটে লড়াই থেকে বিরত থাকতে হবে ৩৬ মাঝিকে। এমন সময় প্রত্যাহার করা হয় এসব প্রার্থী চাইলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়তে পারবেন না।
জাতীয় পার্টিকে ২৬টি এবং ১৪ দলের শরিকদের ৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এছাড়া চারজন নৌকা প্রতীক পেলেও ইসির বাছাই থেকে বাদ পড়েন। ফলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে এসব প্রার্থীকে নীরব ভূমিকায় থাকতে হবে।
ইসির বাছাইয়ে নৌকা হারালেন চার মাঝি
ইসি সূত্র জানায়, বরিশাল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন শাম্মী আহম্মেদ। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগে শাম্মী আহম্মেদের প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি। একই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ নাথের প্রার্থিতা বহাল রেখেছে কমিশন।
ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন শামীম হক। নেদারল্যান্ডের নাগরিকত্বের অভিযোগ তুলে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ তার প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আবেদন করেছিলেন। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকের প্রার্থিতা হারায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া ও পেকুয়া) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম। ফলে নৌকা পেয়েও হারালেন সালাহউদ্দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন এনামুল হক (বাবুল)। ঋণখেলাপির কারণে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে ইসি।
জাতীয় পার্টির কারণে নৌকা হারালেন ২৬ মাঝি
ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মো. ইমদাদুল হক। এ আসন জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
নীলফামারী-৩ আসনে মো. গোলাম মোস্তফাকে নৌকা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেলকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
নীলফামারী-৪ আসনে মো. জাকির হোসেনকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
রংপুর-১ আসনে নৌকা পেয়েছিলেন মো. রেজাউল করিম। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাপার বহিষ্কৃত নেতা মসিউর রহমান (রাঙ্গা)। তিনি টানা দুবারের সংসদ সদস্য। এ আসন জাপাকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে রাঙ্গার পরিবর্তে এবার এ আসনে জাপার প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার।
রংপুর-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন তুষার কান্তি মণ্ডল। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাপার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ। তার মৃত্যুর পর ২০১৯ সালে উপনির্বাচনে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন তার ছেলে রাহগির আলমাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ)। সাদ এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীও হননি। আসনটি এবারও জাপাকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এবার এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
কুড়িগ্রাম-১ আসনে নৌকার প্রার্থী মো. আছলাম হোসেন সওদাগরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তিনি এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। এখানে জাপার প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমানকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
কুড়িগ্রাম-২ আসনে নৌকার প্রার্থী মো. জাফর আলীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আসনটি জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফরুজা বারীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আসনটি জাপার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধা-২ আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য মাহবুব আরা বেগমকে ( গিনি) প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুর রশিদ সরকারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়া-২ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী তৌহিদুর রহমানকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আসনটি জাপার প্রার্থী ও টানা দুবারের সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়া-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী মো. সিরাজুল ইসলাম খানকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আসনটি জাপার প্রার্থী টানা দুবারের সংসদ সদস্য মো. নুরুল ইসলাম তালুকদারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা-২ আসনে নৌকার প্রার্থী মো. আসাদুজ্জামানকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। জাপার প্রার্থী মো. আশরাফুজ্জামানকে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
পটুয়াখালী-১ আসনে নৌকার প্রার্থী মো. আফজাল হোসেনকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আসনটি জাপার কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম রুহুল আমীন হাওলাদারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বরিশাল-৩ আসনে দলীয় প্রার্থী সরদার মো. খালেদ হোসেনকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়াকে (টিপু) ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
পিরোজপুর-৩ আসনে দলীয় প্রার্থী মো. আশরাফুর রহমানকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার প্রার্থী মো. মাশরেকুল আজমকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ-৫ আসনে দলীয় প্রার্থী মো. আব্দুল হাই আকন্দকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদকে (মুক্তি) ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ-৮ আসনে দলীয় প্রার্থী মো. আব্দুছ ছাত্তারকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার প্রার্থী ও টানা দুবারের সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে দলীয় প্রার্থী মো. নাসিরুল ইসলাম খানকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে জাপা মহাসচিব মো. মুজিবুল হককে (চুন্নু)।
মানিকগঞ্জ-১ আসনে দলীয় প্রার্থী মো. আব্দুস সালামকে প্রত্যাহার করে জাপার প্রার্থী জহিরুল আলমকে আসনটি ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ঢাকা-১৮ আসনে দলীয় প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসানকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী ও দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেরীফা কাদেরকে।
হবিগঞ্জ-১ আসনে দলীয় প্রার্থী মো. মুশফিক হুসেন চৌধুরীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে দলীয় প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মো. শাহজাহান আলমের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার প্রার্থী মো. আবদুল হামিদকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পরে জাপা উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র আজ রাতে জানিয়েছে, এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া।
ফেনী-৩ আসনে দলীয় প্রার্থী মো. আবুল বাশারকে প্রত্যাহার করে নিয়ে জাপার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
চট্টগ্রাম-৫ আসনে দলীয় প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুস সালামকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসনটি জাপার প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
চট্টগ্রাম-৮ আসনে দলীয় প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনটি জাপার প্রার্থী মো. সোলায়মান আলম শেঠকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। এ আসনে জাপার প্রার্থী সেলিম ওসমান।
১৪ দলের কারণে কপাল পুড়লো নৌকার ৬ মাঝির
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি, জাসদ তিনটি ও জাতীয় পার্টিকে (জেপি) একটি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওই তিন দলের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। এর মধ্যে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু লড়বেন কুষ্টিয়া-২ আসনে। এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
জাসদকে ছেড়ে দেওয়া আরেকটি আসন বগুড়া-৪। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মো. হেলাল উদ্দিন কবিরাজ। এখন নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়বেন জাসদ নেতা এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর-৪ আসনটিও জাসদকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ফরিদুন্নাহার। এখন নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করবেন জাসদের প্রার্থী মোশারফ হোসেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ঢাকা-৮ আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য। এবার এই আসনে আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। মেনন লড়বেন বরিশাল-২ আসনে। এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন তালুকদার মোহাম্মদ ইউনূস।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে লড়বেন। তিনি এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। এখানে প্রথমে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ আলী।
জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পিরোজপুর-২ আসনে নৌকা প্রতীকে লড়বেন। তিনি এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। এখানে প্রথমে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন কানাই লাল বিশ্বাস।
ফলে ইসি বাছাই তালিকা থেকে বাদ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের জোটের কারণে নৌকা পেয়েও হারাতে হলো ৩৬ মাঝিকে।।