মহাস্থান নিউজ:
আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট মোট ৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এই সংসদীয় আসন। এখানকার রাজনীতিতে বরাবরই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জমজমাট লড়াই হয়। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচনে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করলেও, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান তৃণমূল পর্যায়ে তেমন একটা চোখে পড়ে না।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ করে তাহলে এই আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মূল লড়াই হবে তাদেরই।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির দল দুইটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। ফলে তৃণমূলে তাদের অবস্থা একেবারেই নড়বড়ে। যদিও আসনটির আওয়ামী লীগের জন্য আঁতুড়ঘর গোমস্তাপুর উপজেলা। আওয়ামী লীগের এখন পর্যন্ত যত নেতা ভোটের মাঠে থাকেন অধিকাংশই গোমস্তাপুর উপজেলারই বাসিন্দা। অন্যদিকে বিএনপির ভোট বেশি ভোলাহাট উপজেলায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একবারও আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়নি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবকটি নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন। টানা চার বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জিয়াউর রহমান ও গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস জয়ী হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আমিনুল নির্বাচিত হলেও দলীয় সিদ্ধান্তে পদত্যাগ করায় উপ-নির্বাচনে জয়ী হন জিয়াউর রহমান। ভাগ্যের জোরে জিয়াউর রহমান এখন ‘ডাবল’ এমপি।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বচানে এই আসনে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নাম শোনা যাচ্ছে। তারা সবাই মনোনয়ন প্রত্যাশী। ইতোমধ্যে অনেকেই বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন টাঙিয়ে বিভিন্ন দিবসের শুভেচ্ছা বার্তা জানাচ্ছেন। গেলো উপ-নির্বাচনে চিত্রনায়কা মাহিয়া মাহি সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন তুলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। আসন্ন নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন।
আওয়ামী লীগ থেকে যারা মনোনয়ন চাইবেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খুরশিদ আলম, আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার, রফিকুল আলম সৈকত জোয়ার্দার ও চিত্রনায়কা শারমিন আক্তার নিপা ওরফে মাহিয়া মাহি।
সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান শিক্ষাজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি গোমস্তাপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। শুরুর দিকে তার ভোট ব্যাংক কম থাকলেও বর্তমানে তিনি ওই আসনে বিশাল ভোট ব্যাংকের মালিক। গেলো উপ-নির্বাচনে প্রায় সাড়ে ৬৯ হাজার ভোট বেশি পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন তিনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস। তিনি শিক্ষাজীবন থেকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। এছাড়াও তিনি গোমস্তাপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও গোমস্তাপুর ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। নাচোল আর গোমস্তাপুর উপজেলা তার ভোট ব্যাংক এরিয়া। যদিও জিয়াউর রহমানের চেয়ে তার ভোটার সংখ্যা কম।
গোমস্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিলেন খুরশিদ আলম ওরফে বাচ্চু। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে শুরু থেকে জড়িত নন, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদে রয়েছেন। তারপরেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের উপ-নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোটে জয়ী হওয়াতো দূরের কথা উল্টো তিনি নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী ভোট কম পাওয়ায় তার জামানত বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি যে কোনো দিবস এলেই মোড়ে মোড়ে ফেস্টুন ঝুলিয়ে শুভেচ্চা বার্তা দেন। এর আগেও তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গেলো উপ-নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন জন্য তিনি মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। তার নিজস্ব এলাকায় কিছু ভোট রয়েছে।
রফিকুল আলম সৈকত জোয়ার্দার রাজশাহী মহানগরের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। আরও দায়িত্ব পালন করেছিলেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের। তারও এলাকায় ভোটার রয়েছে।
চিত্রনায়কা শারমিন আক্তার নিপা ওরফে মাহিয়া মাহি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও এই কমিটির রাজশাহী বিভাগের আহ্বায়ক তিনি। স্বপ্ন ফাউন্ডেশন ও ফারিশতা নামের একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠনের চেয়ারম্যানও এই নায়িকা। সম্প্রতি শীত মৌসুমে ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। গেলো উপ-নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ফরম তুলেছিলেন কিন্তু তিনি সফল হননি। নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিয়ে তিনি মাঠে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চেয়েছেন। তার কথায় সাড়া দেওয়ার চেয়ে ‘টিভির মানুষ বাস্তবে’ এই কথার ভিত্তিতে তাকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন উৎসুক জনতা।
আসন্ন দ্বদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ভোটে অংশ গ্রহণ করলে মনোনয়ন চাইবেন মাত্র কয়েকজন। বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম, মহিলা দলের নেত্রী মাসউদা আফরোজ হক (শুচি) ও বিএনপি নেতা বাইরুল ইসলাম।
চাঁপাইনাববগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। তার নির্বাচনী এলাকার লোক তাকে আমিনুল হাজি নামেই বেশি চেনেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির কোনো পদে নেই। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের কারণে তাকে কোনো স্থানীয় কমিটির পদে রাখা হয়নি। মাঝে দলের কোন্দলের কারণে বিএনপির যুগ্মসচিব হারুনুর রশিদের সঙ্গে ‘দা-কুমড়া’ সম্পর্ক থাকলেও, এখন ওই দ্বন্দের আগুন নিভে গেছে। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন।
আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে তারই দলের নেতা কর্মীদের অভিযোগ, করোনার মতো দুর্যোগের সময় তিনি (আমিনুল ইসলাম) ভোটারদের পাশে ছিলেন না। উন্নয়ন থেকে ভোটারদের বঞ্চিত করে তিনি তার ব্যক্তিগত কাজে সময় পার করেছেন।
মাসউদা আফরোজ হক (শুচি) জেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি নাচোল পৌরসভা নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলেন। ভোটের ফলাফল কারচুপির অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখান করেন তিনি। তার ভোট ব্যাংক নাচোল উপজেলা জুড়ে। রাজনৈতিক দলের জেলার দায়িত্বে থাকার সুবাদে আসনটির অন্য উপজেলাতেও তার কিছু সংখ্যক কর্মী-সমর্থক রয়েছে। সাবেক এমপি আমিনুলের ভাবি হলেন শুচি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য ও গোমস্তাপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বাইরুল ইসলাম। তিনি ভোটের মাঠে খুব সরব কিন্তু সেটা তারই উপজেলায়। তিনি অন্য দুই উপজেলায় নিজের পক্ষে ভোটার সংখ্যা বাড়াতে পারেননি। যার কারণে তৃণমূল রাজনীতিতে তেমন একটা প্রভাব নেই তার।
আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে নৌকা প্রতীককে জয়ী করার টার্গেট থাকবে সবার। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন শুধু আমি চাইবো না, আরও অনেকেই চাইবে। সুতরাং দল যেটা সিদ্ধান্ত নেবে সেটা মেনে নিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করে যাবো।’
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী চিত্রনায়কা মাহিয়া মাহি বলেন, ‘দলীয় মনোনয়ন দলের যে কেউ চাইতে পারেন। নির্বাচনের এখনও লম্বা সময় বাকি, ভোটের মাঠে থাকবো কি-না দেখা যাবে। এখনও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করিনি। এলাকার মানুষদের জন্য কাজ করছি, ইনশাআল্লাহ সামনে জনকল্যাণ মূলক কাজ অব্যাহত থাকবে।’
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ভোটের মাঠে আছি, থাকবো। আমি কী কী উন্নয়ন কাজ করেছি আপনারা খুঁজে দেখেন। ইনশাল্লাহ আগামীতে চেষ্টা থাকবে ভালো কিছু করার।’
মহিলা দলের মাসউদা আফরোজ হক শুচি বলেন, ‘দল নির্বাচনে এলে অবশ্যই মনোনয়ন পত্র তুলবো। দল আমাকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে আমার উপর ভরসা রাখবে। মানুষ ধানের শীষ মার্কাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে বলে আমি আশাবাদী।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে জামায়াতের ভোটার সংখ্যা একেবারেই কম। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মীম ওবাইদুল্লাহ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হলে আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী হবেন ড. মিজানুর রহমান। তিনি একটি কলেজের অধ্যাপক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১ হাজার ১৭০ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৪ হাজার ২৮০ জন। এই আসটিতে তিনটি উপজেলাসহ দুটি পৌরসভা রয়েছে।