বগুড়ায় আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া তিনটি আসনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ১৪ দলের শরিক ও জাপা প্রার্থীরা। একইভাবে জেলার সাত আসনের মধ্যে বাকি চারটি আসনও ঝুঁকিমুক্ত নয়। একটি ছাড়া এবার নৌকার প্রার্থীদের জিততে বড় রকমের পরীক্ষা দিতে হবে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা। তবে মাঠের এ হিসেবে বিএনপির সাবেক তিন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বেশ সুবিধায় রয়েছেন।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার সাত আসনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে ৫৪ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপির সাবেক ও নির্দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন ১৩ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া-১ সাহাদারা মান্নান ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনে রাগেবুল আহসান রিপুর আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এ দুই আসনে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি বেশি। শেষ মেয়াদে নানা কারণে এ আসনের সাংসদরা নেতাকর্মীদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করেছেন। এবার শুরুতেই স্বতন্ত্রে বাধা নেই এমন ঘোষণা আসলে দলীয় অনেক নেতাকর্মীই নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা বিভিন্ন সময় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হয়ে গণসংযোগ ও ঘরোয়া বৈঠকে অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে।
এছাড়া বগুড়া-৪ আসনটি বরাবরই জোটের শরিক দল জাসদকে ছেড়ে দেওয়া হয়। দলীয় সিদ্ধান্তে এ আসনে জোটের প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে থাকে। এবারও এ আসনে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন জেলা জাসদের সভাপতি রেজাউল করিম তানসেন। তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার নিজ দলের নেতাকর্মীরাই প্রথমে বিদ্রোহ করে। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করার ঘোষণা দেয়। এদিকে স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদেরও কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না তানসেন। যার কারণে এখানে মাঠ দখলে রয়েছে বিএনপির সাবেক নেতা ডা. জিয়াউল হক মোল্লার। প্রকাশ্য না করলেও পরোক্ষভাবে মোল্লা সবধরনের সমর্থন পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কাছে থেকে।
একই ভাবে বগুড়া-২ আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেওয়া আসনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ ও বগুড়া-৩ আসনে নুরুল ইসলাম তালুকদার চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ আসনগুলোতে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে ধরাশায়ী হতে পারেন তারা। অথচ ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে লিয়াজো করে পাওয়া কোটার এমপি প্রার্থী হয়েছেন তারা।
বগুড়া-২ সংসদীয় আসনের বর্তমান এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্না ২০১৪ ও ১৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে এমপি হয়েছিলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি একইভাবে দলের প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছেন। কোটার প্রার্থী হওয়ায় এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শিবগঞ্জের পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান মানিককে নির্বাচন থেকে সরে যেতে হয়েছে। অথচ দলীয় মনোনয়নের জন্য তিনি মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ বিষয়টি শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে তারা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন জোটের প্রার্থীর সঙ্গে নেই। ভোট করবেন ইচ্ছেমতো। একই ভাবে বগুড়া-৩ আসন থেকে সরে গেছেন আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজুল ইসলাম খান রাজু।
শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তা বলেন, আমরা দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্ত কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছি। কিন্তু যে এমপির সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ নেই। এলাকার উন্নয়নের ধার ধারেন না তার সঙ্গে ভোট করার কোনো মানে হয় না। আমরা ইচ্ছেমতো প্রার্থীকে ভোট দিবো।
আর সিরাজুল ইসলাম খান রাজু বলেন, কার কেমন জনপ্রিয়তা সেটি ভোটের মাঠেই নির্ধারিত হবে। জোটের প্রার্থীর জনপ্রিয়তা থাকলে জয়ী হয়ে দেখাক।
বগুড়া-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাহাদারা মান্নান। এখানে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান (ঈগল) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহাজাদী আলম লিপি (তবলা)। তবে মাঠের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বিএনপির সাবেক নেতা মো. শোকরানার (কেটলি)। তিনি এক অদৃশ্য শক্তি ইশারায় মাঠ গরম করে রেখেছেন। তার সভা-সমাবেশে পুলিশি পাহারা দেখা যাচ্ছে। বিএনপির ভোটারদের বেশ জোর গলায় আশ্বস্ত করে বলেছেন আপনারা ভোট দিতে আসুন। কেউ বাধা দিবে না। পুলিশও আপনাদের সহযোগিতা করবে। হঠাৎ করে শোকরানার এমন প্রচারণাকে রাজনীতির ইউটার্ন হিসেবে মনে করছেন অনেকে।
বগুড়া-৫ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। এ আসনে পাঁচ প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগের মতো শক্ত প্রার্থী নেই। যার কারণে এখানে কিছুটা দলীয় কোন্দল থাকলেও তিনি নির্ভার রয়েছেন।
তবে বগুড়া-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তফা আলম নান্নু রয়েছেন বেকায়দায়। এখানে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী না থাকলেও বড় বাধা হিসেবে আতঙ্ক তৈরি করেছে ঈগল মার্কা নিয়ে বিএনপি সাবেক নেতা সরকার বাদল। ভোট ঝড়ের এ মৌসুমে নিজের জয়লাভ নিয়ে নান্নু নিজেও শঙ্কিত।
তিনি বলেন, নেতাকর্মীরা সবাই মাঠে না থাকলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। লড়াই করতে চাই। আমি মনে করি ভেদাভেদ ভুলে সবাই ভোটের মাঠে নৌকার পক্ষে থাকবে।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু বলেন, তাদের অনেক বড় দল। সবার মন রক্ষা করা সম্ভব হয়না। এ কারণে মনে ক্ষোভ ও বিভক্তি থাকে। তবে এসব সাময়িক। আসনে তারা সবাই নৌকার লোক এটাই বড় পরিচয়। তিনি মনে করেন শেষ সময়ে হলেও সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নৌকার জন্য কাজ করবে। কারণ তারা সকলে মিলে একটি পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলতে চান।